প্রায় সপ্তাহ তিনেক স্বেচ্ছা সিদ্ধান্তে ফেসবুক বন্ধ রেখেছি। হাতের কিছু কাজ গোছানোর অভিপ্রায়ে। এছাড়া আমি মানুষটি এমনটাই। বছর পনেরো-ষোল আগে প্রতি সন্ধ্যায় শাহবাগের বইপাড়ায় আড্ডা না দিলে খাবার হজম হতো না। এখন আড্ডা দিই না বলতে গেলে। সপ্তাহ তিনেক ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি অকেজো করে রেখে ভালই ত’ চলছে। পড়তে পারছি একটু বেশি, ভাবনা-চিন্তা করতে পারছি ভাল মতো। সোজা বাংলায় যখন যেটা করি তখন সেটা প্রবলভাবে করি, আবার একদিন দুম করে ছেড়েও দিতে পারি। অনেকটা বুদ্ধ, কনফুসিয়াস ও লাও সে-র গল্পের মত। এক পিপে মদ আনা হলো এই তিন প্রজ্ঞাবানের সামনে। বুদ্ধ ত’ দেখেই হাত নেড়ে মানা করলেন। কনফুসিয়াস ভদ্রতার খাতিরে এক কণা মদে ঠোঁট ভেজালেন। লাও সে মদ শুধু খেলেন না, পিপের ভেতর সারা রাত গড়াগড়ি দিলেন। পরদিন সকালে পিপে থেকে বের হয়ে যথারীতি ঝরঝরে। এক কথায় জীবনে যখন যেটা খুব করে করার পর বের হয়ে যাওয়া। আড্ডার বিষয়টা আমার ক্ষেত্রে তেমন। তারপরও আসলে ত’ আমি খুব সুবোধ বা সুশীল কোনদিনই নই। ‘নারী নিউজ ইংরেজী’-র একটি কমন ফেসবুক আইডি ‘নারী নিউজে’র তিন সম্পাদকেরই রয়েছে। কখনো কখনো খুব ক্লান্ত বা বিষন্ন হলে সেই আইডিতে ঢুকি।
গতকাল দুপুরে এমন হুট করে ঢোকার পর অবাক হয়ে গেলাম। অনেকটা আফগান বোরখার ঢঙের বোরখা পরা এক মা তার সন্তানের সাথে ক্রিকেট খেলছেন। বহু মানুষ এর ভেতর ‘বাংলার রূপ’ খুঁজে পেয়েছেন আর কিছু নারীবাদী বা এ্যাক্টিভিস্ট এর প্রতিবাদ করেছেন। মিনিট দশেক দুপুরবেলা এসব দেখে বের হয়ে যাই। গতকাল রাতে বা আজ সকালেই আবার কিছুক্ষণের জন্য ঢুকে আমি হাঁ। যারা প্রতিবাদ করেছিলেন, সেই নারীবাদী এ্যাক্টিভিস্টদের কেউ কেউ তীব্র গালি-গালাজের মুখে তাদের আইডি ডিএ্যাক্টিভেট করতে বাধ্য হয়েছেন। এদের একজন যেমন হলেন মুনমুন শারমীন শামস। ব্যক্তিগত ভাবে আমার নিজের সাথেই মুনমুন শারমীন শামসের সম্বন্ধ যে খুব ভাল বা আন্তরিক তা’ নয়। ‘উইমেন চ্যাপ্টার’-এ শুরুতে তাঁর কিছু লেখা পড়ার পর ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরে এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় এক শিশু নিপীড়নের প্রতিবাদে মুনমুনকে দেখে আমিই এগিয়ে পরিচিত হই। ও আমার ফেসবুকে ছিলও না। তারপর আওয়ামি লীগের প্রয়াত নারী এমপি ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পীর সাথে মুনমুনের একবার কিছু সমস্যা হওয়ায় ওর ফেসবুক পোস্ট নানা জনের শেয়ারে আমার টাইমলাইনে আসে। ছাত্রলীগের ছেলেরা যেমন ফেসবুকে মুনমুনেরই টাইমলাইনে শেয়ার করা তাঁর কিছু পাবলিক ছবি শেয়ার করে খুব অনুচিত কাজ করেছে, আবার আমাদের মত দেশে একজন বামপন্থী বা একজন নারীবাদীকে নানা বিষয়ে একটু ভেবে-চিন্তে কাজ করতে পারলে ভাল। সত্যি বলতে নারীবাদ বিষয়ে মুনমুনের সব বক্তব্য বা সব কাজের সাথে আমি একমত এমন নই। যেমন, তৃতীয় বিশ্বে এবং বিশেষত: দক্ষিণ এশিয়ার এই আজো সাংস্কৃতিক ভাবে প্রবলভাবে পিছিয়ে থাকা ও কঠোর পিতৃতান্ত্রিক দেশে আমাকে যখন পেশাগত জীবনে চরাঞ্চল বা বস্তি বা জলোচ্ছাসে আক্রান্ত জনপদে কাজ করতে হয়, তখন নানা বিবেচনা আমাদের মাথায় থাকতেই হয়। খুব সাম্প্রতিক সময়ে হবিগঞ্জ শহরে দু/তিন জন বামপন্থী ও নারীবাদী এ্যাক্টিভিস্টের যে জীবনাচার ফেসবুকের মাধ্যমে জন পরিসরে জানাজানি হলো, সেটা বামপন্থা ও নারীবাদকেই খুব ক্ষতিগ্রস্থ করলো নি:সন্দেহে। মানুষ জানলো কি যে বামপন্থী ও নারীবাদীরা গোপনে গাঁজা খায়, বিয়ে ছাড়াই দৈহিক সম্বন্ধে মিলিত হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ এই ভারত উপমহাদেশে ইলা মিত্র বামপন্থী আন্দোলন করতে গিয়ে যৌনাঙ্গে সেদ্ধ ডিমের পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা পেয়েছেন, রাজশাহী কারাগারে খাপড়া দিবসের শহীদরা মৃত্যুঞ্জয়ী লড়াইয়ে অমরত্ব পেয়েছেন। কিন্তÍ তার মানে ত’ এই না যে মুনমুনের বক্তব্য পছন্দ না হলেই তাকে এমন ভাষায় গালি দিতে হবে যে তার আইডি ডিজেবল করতে হবে? আইডি ডিজেল করতে হয়েছে খোদ ‘নারী’র প্রধান সম্পাদক চৈতী আহমেদকেও। এক খুব ফ্যাশনেবল, সাজু-গুজু মেয়ের স্ট্যাটাসে স্ক্রিনশটে দেখলাম চৈতী, মুনমুন ও শাওন আহমেদের পোস্ট দিয়ে নিন্দা করা হচ্ছে। সেখানে জেগেছে বাংলার তৌহিদী যুব সমাজ!
ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজে খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। এবং অমুসলিম হলেও শৈশব-কৈশোর আমার এত পিতৃতান্ত্রিক শাসনে কেটেছে যে আমার উচ্চশিক্ষিত, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করা বা বড় ডাক্তারি ডিগ্রি নেওয়া এবং আমার চেয়ে বয়সে ষোল থেকে কুড়ি বছরের বড় আপন ভাই বা দাদারাই আমাকে শৈশবে একটু খেলারও অনুমতি দেয়নি। এর ফলাফল আজ তাদের জন্যও কি বুমেরাং হয়নি? যে আমি মাত্র আট বছর বয়সে একবার পাবনা শহরে হরতাল হলে বড় ভাই-বোনদের সাথে ছয় মাইল পায়ে হেঁটে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি শেলাইদহ দেখতে গেছিলাম, সেই আমি আজ পঞ্চাশ পা হাঁটলে অল্প অল্প ঘাম হয়। দক্ষিণ এশিয়ার পিতৃতান্ত্রিক অশিক্ষা এতটাই প্রবল ও ভয়ানক। সেই অশিক্ষা টন টন একাডেমিক ডিগ্রিতে কাটে না। তার মানে এই না যে আমার ভাইরা আমাকে ‘ভালবাসেনি।’ তারা তাদের মত করে নিশ্চিত আমায় ‘ভালবেসেছে।’ শুধু তারা আমাকে স্কুল-কলেজের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময়ে ছাদে উঠতে দেয়নি, খেলতে দেয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। কোন কোন ভাই ব্যতিক্রম ছিল অবশ্য। আমার কবি ভাই তুষার বরিশালে থাকার সময় আমাকে নিয়ে বরিশাল শহরের নানা সাহিত্যিক অনুষ্ঠানে নিয়ে গেছে, সেসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দিয়েছে। তবে আমরা ঢাকায় আসতে আসতে ও রাশিয়া চলে গেছে এবং চোদ্দ থেকে আঠারোর সময়টি যে ভয়ানক ‘অবরোধবাসিনী’র জীবন আমাকে যাপন করতে হয়েছে, সেটাই প্রচন্ড ডিপ্রেশন থেকে আমার ফুসফুসের দূরূহ রোগের কারণ হয়েছে কিনা (ডিপ্রেশন যে কোন ফুসফুসের রোগ থেকে শুরু করে নানা ধরণের ক্যান্সারের বড় কারণ- অন্তত: জাহানারা ইমাম তাঁর ‘ক্যান্সারের সাথে বসবাস’ বইয়ে এমনটাই লিখেছেন) এবং সেই ফুসফুসের রোগ সারাতে গিয়ে আমার একটি পায়ের শক্তি অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে এই বিষয়গুলো সত্যিই জটিল ও বেদনাদায়ক। পৃথিবীতে অধিকাংশ অসুস্থতা বা ব্যাধির শুরুই কোন না কোন মানসিক যন্ত্রণা, কোন না কোন পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বৈষম্যের জায়গা থেকে। আমাদের পরিবারে আমাদের একমাত্র যে ডাক্তার ভাই মানুষ হিসেবে খুব অমায়িক, খুব ভাল তবে খুব রক্ষণশীল এবং ইরাণে বছর দুয়েক কাজ করে (১৯৮৫-৮৭) আরো খানিকটা রক্ষণশীল হয়ে ফেরে এবং যে আমাকে শৈশবে কোনদিন খেলতে অনুমতি দেয়নি, সেই ভাইই আমি অসুস্থ হলে সবচেয়ে বেশি আমাকে নিয়ে ছুটেছে, মুম্বাই থেকে কলকাতা ডাক্তারদের কাছে নিয়ে যাওয়া...আমার পুরো পরিবার আমার জন্য সত্যিই অনেক ‘করেছে।’ আমাদের দক্ষিণ এশীয় পরিবারগুলো না অনেক করে! মেয়েরা যখন মরতে বসে, মরো মরো দশা হয়, তখন করে। অথচ, এত ওষুধ-ইঞ্জেকশন অপারেশন কিছুই হয়তো দরকার হয় না যদি শুধু আপনার কন্যাকে বা আপনার ছোট বোনকে আপনি শৈশবে খেলতে দেন, গায়ে আলো-বাতাস লাগাতে দেন! এটা আমার এক জীবনের উপলব্ধি। তবে, ক্যান্সারের প্রতি আমি কৃতজ্ঞও। ক্যান্সারের সাথে মাত্র আঠারোয় আমার লড়াই আমাকে শিখিয়েছিল যে ‘অবরোধবাসীনী’কেও ঘুরে দাঁড়াতে হয়- বইপাড়ায় সন্ধ্যার পর আড্ডা দিতে বা ‘গ্যোয়েথে’তে সিনেমা দেখতে ইচ্ছে হলে যেতে হয়। কারণ জীবন একটাই। তা’ সেই কয়েক বছরের সান্ধ্য আড্ডায় অংশ নেবার জন্য আবার ‘মন্দ মেয়ে’র বিশেষণও জুটেছে একটা সময়। বহু বছর আগে কয়েকটি বছর নিয়মিত অনেক ছেলে-মেয়ে মিলে সন্ধ্যাবেলা শাহবাগের রাস্তায় খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে সাহিত্য বা রাজনীতির আলাপের জন্য আবার এই প্রাক-প্রৌঢ়ত্ব সময়েও গত কয়েক বছর নিয়মিত খুব প্রগতিশীল কেউ কেউ ফেইক আইডি থেকে বিস্তর আমাকে ‘খানকি-বেশ্যা-পিঁপড়া বসা চিনি-মাছি ভনভন মাংস’ এসব শুনিয়েছে।
মূল প্রসঙ্গে আসি। হাতের অনেক জরুরি পড়া-লেখার কাজ ফেলে এই লেখাটি যে আমি লিখতে বসেছি, তা’ কয়েকটি কারণে বসেছি। শুধু বোরখা নয়, লক্ষ্য করুন কখন এই সমাজে এই ‘বোরখা পরা মায়ের ক্রিকেট খেলা’র বন্দনায় মানুষ মুখরিত হচ্ছে? যখন এই মা আগে বা অবিবাহিত জীবনে ‘খেলোয়াড়’ ছিলেন তবে ‘বিয়ে করা’ ও ‘মা হবার পর’ আর ‘খেলেন না’ তবে ‘সন্তানের আব্দারে খেলেন।’ এবং প্রচন্ড গরমে সিনথেটিক কাপড়ের চোখ-মুখ ঢাকা বোরখা পরে খেলেন। যে সমাজ কলসিন্দুরের ফুটবলে সোনাজয়ী মেয়েদের লোকাল বাসে হ্যারাস করে, নারী ক্রিকেটার ও ফুটবলারদের প্রয়োজনীয় পারিশ্রমিকটুকু দিতে রাজি হয়না, সেই সমাজ বা সেই দেশেরই বৃহত্তম পত্রিকা এই ‘বোরখা পরা মায়ের’ ইন্টারভিউ নিতে তাদের হাউজের কোন তরুণী-সুশ্রী-রুচিশীল-বুদ্ধিদীপ্ত-শিক্ষিতা নারী সাংবাদিককে ন্যস্ত করেন। তা’ এমন নারী সাংবাদিকের সাথে ‘বোরখা পরা মা’ ভালভাবে ‘বাংলা’টাও দুই মিনিট বলতে পারলেন না। সন্তানকে ‘মাদ্রাসা’য় দেবার কথা জানালেন সেই মা। এক মিনিটও দেখার রুচি হলো না সেই ভিডিও। এইরে- এখনি ত’ আমাকে সবাই ‘কালাচারাল এলিট’ বলে গালি দেয়া শুরু করবেন, তাই না? না- দয়া করে একটু লেনিন পড়েন। সব শ্রমিক যেদিন তলস্তয় পড়ে বুঝতে পারবে এবং বলশয় ব্যালে উপভোগ করতে পারবে, সেদিন ‘সমাজতন্ত্র’ সফল হবে লেনিন বলে মনে করতেন। আমি ‘দরিদ্র’ বলে আমার স্বপ্নও ‘দরিদ্র’ হবে? আমি ত’ খুব চাই যে এই বাংলাদেশের প্রতিটা ছেলে-মেয়ে শুধু ‘প্রমিত’ বাংলা নয় (কলকাতার টিভি সিরিয়ালের ‘বুঝদে পারছি না’-ও নয়, ‘বুঝতে পারছি না’-র খাঁটি প্রমিতটা বলতে পারুক- মন চাইলে মাঝে মাঝে ‘বুঝতেছি না’-ও বলতে পারে অবশ্য), বিশ্বায়ণের সাথে তাল মেলাতে শুধু ইংরেজি না, ফরাসী-স্প্যানিশ-ইতালীয়-জাপানী-চীণা খুব ভাল বলতে ও লিখতে পারুক, আইটিতে অনন্য হোক, সারা বিশ্বে বিমানের লেজে চেপে অদক্ষ ও বিপন্ন শ্রমিক হিসেবে নয়, সেরা এমপ্লয়ি হিসেবে ছড়িয়ে পড়–ক। তারা আবিদা পারভীনের সুফী র্যাপ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বা মীরার ভজন কি বিঠোফেনের সিম্ফনী সব কিছুর রসাস্বাদনে সফল হোক। কিন্তÍ এই যে একটি ভয়ানক বাজে অনুশীলন শুরু হয়েছে বাংলাদেশে যে ভুল বানান লেখায় দোষ নেই, প্রমিত বাংলা বলতে না পারায় দোষ নেই, ইংরেজিতে সামান্য সড়গর হওয়াই যেন প্রতিটি অফিসে ব্যবহারে সবচেয়ে বিনীত হয়েও অন্যদের দ্বারা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে বিতাড়িত হবার মত উল্টো পাপ...এ কি ভয়ানক আত্মঘাতী প্রবণতা? এটা আমাদের জাতি হিসেবে কোথায় নিয়ে যাবে বা যাচ্ছে?
গতকাল মুনমুন শারমীন শামসের পোস্টে কিন্ত ওর অন্য পোস্টের মত চড়া সুরে কোনো শব্দও ছিল না। কিছু ভাল অবলোকনও ছিল। মুনমুন লিখেছেন যে বিদেশে একবার এক জাহাজে দেখছেন যে এরডোগানের দেশের এক দম্পতির পুরুষটি বেলী ড্যান্সারের কাছে গিয়ে নাচ দেখছেন আর নারীটি বহু কষ্টে বোরখার নেকাবের ভেতর থেকে খাবার খাচ্ছেন। হ্যাঁ- আবারও বলি মুনমুনের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্বন্ধ ভাল নয়। বাপ্পী আপার সাথে মুনমুনের সেই ঘটনার পর আমি একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ামূলক লেখা লিখেছিলাম। উত্তরে মুনমুন উল্টো আমাকে বন্ধুত্বের আবেদন পাঠালে আমি গ্রহণ করি। এর কিছুদিন পর আর এক নারী ফেসবুকার সম্প্রতি যার শিক্ষাগত যোগ্যতার দাবি কতটুকু যৌক্তিক কি যৌক্তিক নয় সেসব বিষয়ে ফেসবুকে প্রচুর পোস্ট আমরা দেখলাম, যার পেশাগত জীবন নিয়েও অনেক আলাপ হতে দেখলাম এবং এমনকি তথ্য-প্রমাণ সহই এবং সেটাও নিশ্চিত এদেশের নারীবাদী আন্দোলনকে আবারও প্রশ্নের মুখোমুখি করলো...তা’ সেই নারী ফেসবুকার বছর দুই আগে আমাকে ভয়ানক আক্রমণ করলে আমি একটি পাল্টা পোস্ট দিই। সাথে সাথে মুনমুন সেই নারী ফেসবুকারকে মহিমান্বিত করে একটি পোস্ট দিলেন এবং সেখানে প্রথম লাইকটি দিলেন আর এক প্রগতিশীল ফেসবুকার ইমতিয়াজ মাহমুদ। ভড়কে গেলেও আমি মুনমুনকে তখন অবন্ধু করিনি। কিন্তÍ অল্প কয়েকদিনের ভেতরেই মুনমুনকে দেখলাম সেই নারী ফেসবুকারের বিরুদ্ধে লিখতে। তখন কেন জানি আমার মনে হলো যে নৈতিক প্রশ্নে নয়...যদিও আমার ‘ব্যক্তিগত সাফল্য’ বলতে কিছু নেই...তবু আমার দশ বছরের বড়, সমবয়সী থেকে দশ বছরের ছোট অবধি একটি এইজ গ্রুপে আমি বহু বছর ধরে কেন জানি অনেকেরই একটি নীরব অস্বস্তির কারণ...মুনমুন কি কোন ব্যক্তিগত অস্বস্তি থেকে এমনটা করলেন আমার সাথে? তখন আমি তাঁকে অবন্ধু করি তবে সম্প্রতি ভারতের একটি জেন্ডার বিষয়ক ওয়েবিনারে তাঁর সাথে আমার আবার ফেসবুক লাইভে দেখা হলো । হ্যাঁ, অস্বীকার করব না যে সেই সময় আমি ইমতিয়াজ মাহমুদকেও অবন্ধু করেছি। মজার বিষয় হলো সম্প্রতি যে নারী ফেসবুকারের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশাগত বিষয় নিয়ে এত আলাপ হলো, একদম শুরুতে তার কিছু লেখাও আমি শেয়ার করেছি ও প্রশংসা করেছি। তবে ক্রমাগত নানা মানুষকে অকথ্য যৌন গালাগালি করতে থাকার কারণে তাকে একসময় বাতিল করি। এবং এতকিছুর পরেও তার আজকের এই অবস্থায় তার জন্য খারাপও লাগছে। খানিকটা অবাকও লাগছে যে কতখানি বিপন্ন মানসিকতার হলে কিছু ‘বাম’ ও কিছু ‘ইসলামপ্রেমী’ মানুষ এই বিকিনি পরা, ট্যাটু করা, ক্ষণে ক্ষণে নানা যৌনসঙ্গীর সাথে শয্যার ছবি দেয়া ও নিজেই নিজের ‘চিনি বাবা’র গল্প করা এই নারী ফেসবুকারকে ‘ইসলাম’ বাঁচানো ও আওয়ামী লীগের হাত থেকে ‘দেশ উদ্ধারের’ প্রতীক হিসেবে আঁকড়ে ধরছে।
আবারও বলি মুনমুনের সব কাজ বা সব কথার সাথে আমি একমত নই। হ্রস্ব পোশাক, মদ্য বা ধূমপান পশ্চিমের নারীবাদী করলেও আমাদের মত দেশে এমন আচরণের প্রেক্ষিত আজো তৈরি হয়েছে কিনা এবং বিশেষত: আরো যারা জনপরিসরে কাজ করেন, সেটা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত দ্বিমত আছে। এমনকি ভারতীয় সেই ওয়েবিনারে দেখা হবার পর ও সেখানে স্বদেশী দুই বক্তা হিসেবে হৃদ্যতার সাথে আলাপের পরও আমার ব্যক্তিগত আইডিতে তাঁকে এখনো পুনরায় যুক্ত করিনি। কিন্তÍ তাই বলে মুনমুন তার নিজের টাইম লাইনে এই গরমে দম-বন্ধ বোরখা পরা এক মহিলার ক্রিকেট খেলার বিরুদ্ধে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত দিতে পারবেন না?
এক কথাসাহিত্যিক বোরখা পরা মায়ের গুগুলিতে ‘কালচারাল এলিট’দের মিডল স্প্যাম্প আউট হতে দেখেছেন। কথা সাহিত্যিকের কাছে সবিনয়ে জানতে চাইব যে আজকের এই যে চোখ-নাক-কাণ বন্ধ করা বোরখা, স্বয়ং নবী মুহাম্মদ (স:) কি এই ঠিক এই বোরখাতেই নারীকে আবৃত হতে বলেছেন? দেখা যাক ‘হিজাব’ বা ‘বোরখা’ এসব বিষয়ে খোদ কোরাণে কি বলা হয়েছে?
কোরাণে মুসলিম নর-নারী উভয়কেই পরিশীলিত ভাবে পোশাক পরতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে তাদের দৃষ্টি, চলা-ফেরা, পোশাক ও যৌনাঙ্গ যেন নমিত, আবৃত থাকে। আজকে ‘হিজাব’ বলতে নানা রঙের, পাথর ও চুমকি বসানো ও নানা কারুকাজের যে মাথার রুমালটি নানা দেশে মুসলিম নারীরা ব্যবহার করছেন, মহানবীর সময়ে আরবে ‘হিজাব’ বলতে বিশেষত: নবী পরিবারের নারীদের সাথে অনাত্মীয় পুরুষদের মাঝে পরদার মত টাঙ্গানো একটি কাপড় বুঝাতো। তবে বুক বা স্তন ঢাকতে ‘খিমার’ ও ‘জিলবাব (একটি আজানুলম্বিত পোশাক)’ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। কোরানের ৬,০০০ সুরায় আধা ডজন বা মাত্র ছ’টি সুরায় নারীর পোশাক ও জনপরিসরে সে কিভাবে চলা-ফেরা করবে সে বিষয়ে বলা হয়েছে। সুরাহ ২৪:৩১-এ নারীকে তার যৌনাঙ্গ ঢাকতে ও খিমার দিয়ে ‘বুক’ আবৃত করতে বলা হয়েছে। এই ভারত উপমহাদেশের শাড়ির আঁচলের মতই। শ্রীলঙ্কার ‘রাক্ষস’ বা ‘দ্রাবিড়’ নারী আজো আন-অফিসিয়ালি সব সময় বুকে আঁচল না ঢেকেই চলে। তবে উত্তর ভারত থেকে পূবে বাংলা অবধি নারীকে বুকে আঁচল ঢাকতেই হয়। আঁচল হলো উপমহাদেশের খিমার। পাকিস্থান বা আফগানিস্থানে কামিজের সাথে বুক ঢাকতে যেমন ‘ওড়না’ ব্যবহার করা হয়। চমকপ্রদ বিষয় হলো খোদ আরবে ইসলামের আদি যুগে চুল ঢাকতে কোন কড়াকড়ি বিধানও কোথায় নেই। নারীকে অবশ্য দৃষ্টি নমিত রেখে চলা-ফেরা করতে বলা হয়েছে যেমনটা আমাদের মায়েরা থেকে শুরু করে আমাদের স্কুল শিক্ষিকারা শৈশব-কৈশোরে আমাদের শিখিয়েছেন। এমনকি ছেলেদের ভেতরেও আপনার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা ছেলেটির চেয়ে এক ঝলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া ছেলেটাকে যেমন আপনি ‘ভদ্র, ব্যক্তিত্ববান’ ভাবেন তেমন। এছাড়াও খোদ রুশ বইয়ের অলঙ্করণেই দেখবেন এই বিশ শতকের শুরু অবধি নায়িকাদের মাথায় রুমাল বা হ্যাট রয়েছে, ‘স্টার জলসা’-য় ‘মহাভারত’-এ অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাট রাজার প্রাসাদে পরিচারিকার ছদ্মবেশে দ্রৌপদী যেহেতু দু:শাসনের হাতে অপমানের প্রতিবাদে বিবাহিতা নারী হয়েও চুল খোলা রাখছেন (অপমানের প্রতিকার না হওয়া অবধি চুল বাঁধবেন না বলে), তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে যে ‘বিবাহিতা’ হয়েও সে কেন চুল বাঁধছে না? ‘হিজাব’ না থাকলেও ‘বিবাহিতা’ নারীকে চুল অন্তত: বেঁধে রাখতে হচ্ছে। তবে দেবীরা সবসময়ই মুক্তকুন্তলা- কালী থেকে সরস্বতী সবাই! তাঁরা যে নিজ নিজ গুণে স্বরাট। তাঁদের ‘লুপ্ত কেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনী।”
আজকে ইসলামকে যেমন নারী বিষয়ে নাক-চোখ-মুখ-শ্বাসনালী বন্ধ করা এক বিধান হিসেবে প্রমাণ করতে উঠে-পড়ে লেগেছে এদেশের খোদ কালাচারাল এলিট এক শ্রেণির বামও, ইসলাম কি আসলেই অতটা ‘আট কুঠুরী নয় দরোজা/মধ্যে মধ্যে ঝরোকা কাটা’ কঠোরতা? কি বলছে কোরানে? বলছে নারীরা যেন তাদের ‘রূপ ও অলঙ্কার’ না দেখায়: রূপ ও অলঙ্কার বলতে এখানে ‘স্তনের’ কথাই বলা হয়েছে। কেননা তার পরেই বলা হচ্ছে যে তারা যেন ‘খিমার’ দিয়ে তাদের ‘স্তন’ ঢাকে এবং এই ‘রূপ’ (পড়–ন স্তন) শুধুমাত্র মেয়েদের স্বামী, বাবা, শ্বশুর, ছেলে, স্বামীর ছেলে (সতীনের ছেলেও হতে পারে), ভাই ও ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, অন্য নারী, ক্রিতদাস যাদের ডান হাতে অধিকার করা যায় অথবা পুরুষ ভৃত্য যাদের যৌন চাহিদা নেই (ধরুন বালক, বৃদ্ধ বা খোজা ভৃত্য) অথবা যৌনতা বিষয়ক কোন জ্ঞান বা লজ্জা হয়নি এমন পুরুষ শিশুর সামনে প্রকাশ করা যাবে। দেখুন এই তালিকাটাও বেশ লম্বা। সোজা বাংলায় আত্মীয় পুরুষদের সামনে সবসময় এমনকি ‘বুকে ওড়না’ না থাকলেও চলে (কোরান- সুরাহ ২৪:৩১)। আজকের এই যে আদ্যোপান্ত চোখ-মুখ ঢাকা বোরখা এটা আরবরা নিয়েছে পারস্য জয়ের পর পারস্যের অভিজাত শ্রেণি থেকে। পারস্যের ‘শাহেনশাহ’ বা নৃপতি গোষ্ঠির নারীদের সাধারণ নারী থেকে আলাদা করতে এটা পরা হতো বলে জানা যাচ্ছে জওয়াহেরলাল নেহেরুর ইন্দিরাকে লেখা ‘Glimpses of the World History’ বইটিতে। না- ‘মামণিকে বাবা’ নামের ক্ষুদ্রায়তণ বাংলা অনুবাদটিতে এই তথ্য আছে কিনা জানি না। আমি মূল বইটা থেকে পড়েই যা জেনেছি সেটা লিখলাম। আসলে আদি গোত্র ব্যবস্থা থেকে ইসলাম চালু হবার প্রাথমিক যুগ অবধি আরবের কৌম সমাজ ছিল বরং তুলনামূলক অনেক সরল ও অনাড়ম্বর। সেখানে আঠারোর বিধবা তরুণী আয়েশা উটের পিঠে চড়ে যুদ্ধ করলে বিপক্ষের পুরুষ সেনাপতিরা হাল্কা কৌতুক মাত্র করেন: ‘হে হুমায়রা (‘হুমায়রা’ শব্দের মানে যিনি খুব শ্বেতকায়া বা মহাশ্বেতা)! এই রোদে তুমি কেন উটের পৃষ্ঠে চড়েছ?- দেখুন ফাতিমা মেরনিসির ‘হিডেন ফ্রম হিস্ট্রি- দ্য ফরগটেন ক্যুইনস অফ ইসলাম)’ বা সেই আরবে চল্লিশের বিধবা ও ধনাঢ্য নারী উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী খাদিজা তাঁর তৃতীয় বিয়েটি করেন পঁচিশের নবী মুহাম্মদকে এবং তাঁর সাথে একাধিক সন্তানের জননী হন। তা’ সেই ১৫০০ বছর আগে উনি চল্লিশে বিয়ে করে সেই মরুভূমিতে একচল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বা তারপরেও মা হন। আর আপনাকে ডাক্তার বা সমবয়সী শিক্ষিত যুবক কি বলে? পঁয়ত্রিশের পর ওভারির ডিমের মান খারাপ হয়? বাচ্চার ডাউন সিন্ড্রোম হবে? পঁয়ত্রিশের পর পুরুষের বীজের কোয়ালিটিও খারাপ হয়। এগুলো বলা হচ্ছে আপনার শিক্ষা, কেরিয়ারের অগ্রগতিতে আপনি যেন থমকে যান সেজন্য ‘জুজু বুড়ি’র ভয় দেখানো হিসেবে। মেডিক্যাল সায়েন্সে ১৫-৪৯ পুরো সময়কালটাই নারী মোটামুটি সন্তান ধারণে সক্ষম বলে বলা হচ্ছে। অন্তত: যতদিন সে রজস্বলা থাকে ততদিন। আজ যে পুরুষ কথায় কথায় আপনাকে ‘খানকি মাগী-হিজাব কই?’ বলে, সেই ‘বোরখা পরা মায়ে’র পোশাকের স্বাধীণতার কথা বলতে আসছে? মজা ত’?
এই লেখাটি শেষ করব এক বিচিত্র মানসিকতার পুরুষের স্ক্রিন শট শেয়ার করে। ইনি আমার ফেসবুকে নেই। গতকাল এক পরিচিতের শেয়ারে দেখলাম। সেখানে এই ব্যক্তি ‘বোরখার রূপে’র পক্ষে বলতে গিয়ে শাড়িকে বলছেন ‘বক্ষ-উদর-নিতাম্বয়ব’ দেখানো ‘লুঙ্গি’র মত পোশাক। তাই? জানতে কৌতূহল হচ্ছে যে মোহাম্মদ আদনান আরিফ সালাম নামে এই ব্যক্তির মা বা মাতামহীও ‘বক্ষ-উদর-নিতাম্বয়ব’ দেখানো ‘শাড়ি’ কি জীবনেও পরেননি? তাদের বিয়ে হয়েছিল কোন্ পোশাক পরে? এভাবে আমাদের সবার মা বা মাতামহীকে উনি অপমান করতে পারেন? আমি নিজে যেমন একাত্তরের পরে জন্মানো মেয়ে। শাড়িতে আমি অত স্বচ্ছন্দ বোধ করিনা। হালে আমরা মিডল ইনকাম কান্ট্রি হচ্ছি। সালোয়ার-কামিজ, লেগিংস-লন, কাফতান-প্যালাজ্জো সহ নানা পোশাক আমরা কিনতে ও পরতে পারছি। তা’ আমার মা বা মাতামহী বা ওনার মা বা মাতামহী কি এই ‘বক্ষ-উদর-নিতাম্বয়ব’ দেখানো পোশাক পরেননি? ১৯৭২ সালের বাংলাদেশী এক টাকায় যে ব্লাউজহীন গ্রামীণ মেয়েরা ধান ভানছে- সেই সময় নারীর প্রতি এত যৌন সহিংসতা ছিল না কেন? তখন ত’ এত হিজাব-বোরখা ছিল না চারপাশে! প্রবল বিদ্বেষ ও ঘৃণা উগরে এই আদনান আরিফ সালাম মেয়েদের কপালের ‘টিপ’কে বলছেন ‘ম্যানহোলের ঢাকনার মিনিয়েচার’ সাইজের টিপ। তাই? টিপের তুলনায় ম্যানহোলের ঢাকনার কথাই মনে এলো? সত্যি বলতে খুব বড় আকৃতির যে টিপটা অনেক নারী শিল্পী, অভিনেত্রী বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব যেমন পরেন, আমি ঠিক অতটা বড় আকৃতির টিপ পরতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি না একারণে যে মনে হয় এতে আমার চেহারা যেমন হোক- আমি খেঁদি-বুচি বা সুচিত্রা সেন যাই হই না কেন, আমার মুখের প্রতি অনাহুত অনেক বাড়তি দৃষ্টি পড়বে। আর মেয়েরা ত’ বঙ্কিম যেমন বলেন যে ‘যৌবনে কুক্কুরীও ধন্যা’ (অবশ্যই আর একটি ভয়ানক পুরুষতান্ত্রিক কথা) আর তাই আপনি যেমনই দেখতে হোন, কিছু বাড়তি দৃষ্টি পড়েই আপনার দিকে যেজন্য কিনা ফ্রাঞ্জ কাফকার অনু গল্পে সুন্দরী মেয়েরা দিন শেষে বাড়ি ফিরে আয়নায় দেখে নিজের মুখে সারা দিন অনেক পুরুষের চোখ পড়ে মুখটি ধূলিতে লিপ্ত হয়েছে- আমি সুন্দরী না হয়েও এমন ফিলিংস আমারও বহুবার হয়েছে! তাই বলে তার সমাধান কি? নাক-মুখের ছিদ্র রোধকারী বোরখা পরা? হ্যাঁ, নানা পোশাকের রঙের সাথে মিলিয়ে মাঝারি আকৃতির কিছু টিপ আমারও আছে। তাই বলে কেউ খুব বড় টিপ পরলে তাকে ‘ম্যানহোলের ঢাকনা’ মনে হতে হবে? বাংলার সবুজ পতাকায় লাল সূয্যিটার সাথে মিল পাওয়া গেল না?
আদনান আরিফ সালাম নামে এই ফেসবুকার তার লেখা শুরু করেছেন ‘এসাইলাম ভিখারী নারীবাদ’ নামে। মানে কী? এত এত ব্লগার, লেখক, প্রকাশক খুন হলেন? তা’ সবাইকে এই ভাবে চাপাতির নিচে মরতে হবে? ভাল ত’? নেহাত যদি ২০১৬-র জুলাই মাসে গুলশানের এক দামি কাফেতে অতজন বিদেশী খুন না হতেন, এখনো মুক্ত চিন্তক হত্যা অব্যাহত থাকতো। তাতে আজ দেশে আমরা সবাই কথা বলছি অনেক ভেবে-চিন্তে, রয়ে-সয়ে। আমি বলছি না যে মুক্ত চিন্তার মানে প্রতি পলে পলে ইসলামের প্রচারক পুরুষের ব্যক্তি জীবন নিয়ে কটাক্ষ করতেই হবে। তাঁর প্রচুর ভাল কাজও ছিল। যেমন, মেয়েদের সম্পত্তিতে সেই সময়ের প্রেক্ষিতে পঞ্চাশ শতাংশ হলেও অধিকার দেয়া বা বিয়ে বিচ্ছেদের সীমিত অধিকার হলেও দেয়া। আবার সেসব ভাল কাজের প্রশংসার সাথে তাঁর নাবালিকা শিশু কন্যা বিয়ে করাটা যদি কাউকে আহত করে, সেটাও পরিমিতির সাথে কারো বলার অধিকার বাক স্বাধীণতায় বিশ্বাস করলে থাকা উচিত। নগ্ন কালী প্রতিমায় যারা নারী শক্তি বা অনেক কিছু খুঁজে পান, আমি জন্মসূত্রে অমুসলিম হয়েও শৈশব থেকেই ঠিক রবীন্দ্রনাথের মতই খানিকটা ‘কালী বিরোধী।’ ভাল লাগে না এই দেবীর অমন রক্ত-পিপাসা। কিন্তÍ ‘আঁতেলদের জ্বালা’য় সেটা বলা যাবে না। বললেই তারা ‘নারী শক্তি, দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদ’ থেকে শুরু করে ফিজিক্সে উধৎশ গধঃঃবৎ সহ নানা কিছু বোঝাতে আসবেন। হ্যাঁ, এই ‘সেক্যুলারিজম’ কিন্তÍ একটু ভাববার মত। কিন্তÍ আমার যে ভাল লাগে না এই শোণিত পিপাসী দেবীকে! এখন সেটা কি বলা যাবে না? বললেই আমি ‘এসাইলাম ভিখারি’ আর খুন করতে আসবেন আমাকে? গত পাঁচ রাত ধরে পাকিস্থানী সূফী গায়িকা আবিদার গলায় ও শেখ সাদির লেখা ‘বালাগায়ে উলা কামেলিয়াহি’ নামে নবী বন্দনা শুনছি। শবে মেরাজের রাতে মহানবীর সাত আসমান বা সপ্ত আকাশ ঘোরা নিয়ে শেখ সাদির এই গীতিকবিতা নিয়ে অনেক যান্ত্রিক যুক্তিবাদী ঠাট্টা করতে পারেন। কিন্তÍ আমি ঠিক যেভাবে গ্রিক পুরাণের ইউরিপিদিসের পাতালে যাবার কাহিনী বা ওদিসিয়ূসের নানা দেশ-দ্বীপ ভ্রমণের কাহিনী পড়ি, পড়ি হিন্দু বা সুমেরীয় পুরাণ, শবে মেরাজের এই পুরাণ রূপকল্পনা ততটাই সুন্দর। আবিদার গান শুনতে শুনতে আমার দেহে নৃত্যের দোলা লাগে। কিন্তÍ আমার বাসার আধা মাইলের ভেতর পাঁচটি মসজিদ থেকে পাঁচবেলা পঁচিশবার যখন মাইক্রোফোনে আজান হয় এবং লক ডাউনে আমরা ঘরবন্দী, তখন কি এদেশের এক নাগরিক হিসেবে শব্দ দূষণের কথা তোলার অধিকার আমার আছে অথবা নেই? যেখানে খোদ কোরানেই একটি মসজিদের আজান যত দূর যায় তার ভেতরে দ্বিতীয় মসজিদ স্থাপণ করতে মানা করা হয়েছে? আর একটি কারণেও আবিদার গান হয়তো আমার ভাল লাগে যে সেটা এই উপমহাদেশের পরিচিত সুর কাঠামোয় সৃষ্ট আর আজান হচ্ছে আরবী ভাষায় ও আফ্রিকার ক্রিতদাস হযরত বেলালের দূর মধ্যযুগের আফ্রিকীয় সুরে সৃষ্ট। একে ত’ আরবী এক অক্ষর জানি না তাতে দূর আফ্রিকার সুর অত পরিচিত নয় আমার কাণে। এখন এই কথাগুলো আমার বলার অধিকার আছে কি নেই? বললেই আমি ‘এ্যাসাইলাম ভিখারি’ আর ‘ইসলামোফোব?’ ভাবুন, একটু ভাবা প্র্যাক্টিস করুন।
না- দু:খিত, এই বোরখা পরা মায়ের ক্রিকেট খেলার ভেতর ‘বাংলার রূপ’ আমি খুঁজিয়া পাই নাই। ইরাণী নারীবাদী হাইদে মোগহিসির কথা আবারও বলতে চাই যে ‘বোরখা’ ও ‘বিকিনি’ দুটোই পিতৃতন্ত্রের নারীর উপরে চাপানো চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নমুনা। একটি তার ভোগের জন্য মেয়েটিকে পুরো ‘খুলে’ দেখতে চায় এবং আর একটি তার ভোগের জন্যই মেয়েটিকে পুরো ‘ঢেকে’ রাখতে চায়। মেয়েটির এখানে কিছু বলার নেই। এখানে পোশাকের স্বাধীণতা বলতে কিছু নেই। কারণ আপনারা একজন নারীর ‘জিন্স’ পরার স্বাধীণতা কিন্তÍ মানতে চান না। আদনান আরিফ নামে ফেসবুকার সম্ভবত: মুনমুনের স্লিভলেস ব্লাউজ পরাকেই কটাক্ষ করেই আরো বাজে কথা বলেছেন যা উদ্ধৃত করছি না। ব্যক্তিগত ভাবে আমি খুব ছাপোষা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে বলেই স্লিভলেস পরার কথা হয়তো কখনো ভেবেও উঠতে পারিনি। আবার আমাদের প্রজন্মের মেয়েরা আমার মত অনেকেই হয়তো আজীবন এদেশে সালোয়ার-কামিজে চিবুক থেকে পায়ের পাতা ঢেকে রাখতে হবে জেনেও শুধু ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার জন্যই বাহু মূল থেকে পায়ের পাতা অবধি ওয়াক্স করেন। হাঁটুর উপর পোশাক পরার ইচ্ছা হয়নি কখনো তবে মাঝে মাঝে মনে হয় যে হাঁটু অবধি একটি ঝশরৎঃ পরার অধিকার আমার নেই কেন? তখন কিন্তÍ পোশাকের স্বাধীণতা আমরা পাচ্ছি না! আর সবচেয়ে বড় কথা ইসলামে কিন্তÍ নর-নারী কারোরই ক্রিকেট খেলার অধিকার নেই।
যাহোক, যে ভাষায় চৈতী আহমেদ, মুনমুন শারমীন শামস বা শাওন মাহমুদকে গতকাল তাঁদের মত প্রকাশের জন্য আক্রমণ করা হয়েছে তা’ দু:খজনক ও প্রমাণ করে কাবুল থেকে আমরা মোটেই ‘পিছিয়ে’ নেই। যে সুইডেন কিছুদিন আগেও সবচেয়ে বেশি আফগান ও সিরীয় রিফ্যুজিদের আশ্রয় দিয়েছে, সেই রিফ্যুজিরা যখন সুইডিশ জীবন যাপন ও মূল্যবোধকে আক্রমণ করতে গেছে, তখন সেই সুইডেনে সেদিন কোরান নিয়ে ফুটবল খেললো ডানপন্থীরা। ভয়ানক নিন্দনীয় বিষয় অবশ্যই তবে ঘটলো এই ঘটনা! কাজেই এখন ভাবার সময়। নিজের দেশে না হয় খোমেনী বা তালিবানী বিপ্লব করলেন, বাকি পৃথিবীতে ধীরে ধীরে আশ্রয়হারা হয়ে যাবেন না ত’ এই ক্রমাগত উগ্রতার জন্য?