ভারতে আবার ঘটে গেলো এক ভয়ানক ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। এবার এই ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের শিকার হলেন এক ১৯ বছরের দলিত তরুণী মনীষা। গত মাসে উত্তর ভারতের হাথরসে চারজন উচ্চ বর্ণের যুবক মনীষাকে এমন ভয়ানক ভাবে ধর্ষণ করে এবং একই সাথে তার গলা টিপে শ্বাসরোধ করার জন্য মনীষার জিহ্বা ছিঁড়ে যায়, ভেঙ্গে যায় মনীষার মেরুদন্ড। কোমরের নিচের অংশ প্যারালাইজড হয়ে যায় মেয়েটির। দিল্লীর এক হাসপাতালে দু’সপ্তাহ লড়াই করার পর মেয়েটি মারা গেলে যখন ভারতীয় সামাজিক মাধ্যম, জাতীয় সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে, তখনও স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তারা ঘটনাটিকে ‘মিথ্যে সংবাদ’ বলে কাটিয়ে দিতে চান। যদিও ভিক্টিম মেয়েটি নিজেই চার আক্রমণকারীর নাম প্রকাশ করে থানায় একটি এজাহারও দায়ের করেছিলেন, উর্দ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা মেয়েটির ধর্ষণের শিকার হবার বা জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ শুধু অস্বীকার করেন না, গোটা ঘটনাটি ধামা চাপা দিতে ভারতীয় পুলিশ মাঝরাতে মেয়েটির মরদেহ শ্মশানে নিয়ে গিয়ে তড়িঘড়ি করে দাহ করে। তবে, ‘ইন্ডিয়া টু ডে’-র এক অকুতোভয়, নারী সাংবাদিক গভীর রাতেও শ্মশানে দূর থেকে পুলিশের এই কালো প্রহসন তাঁর ক্যামেরায় রেকর্ড করলে দেশবাসী জানতে পারে এই ভয়ানক ঘটনা। শ্মশানে মেয়েটির উপর করা সব অন্যায়ের আলামত ধামা চাপা দিতে তড়িঘড়ি দাহ করার সময় মেয়েটির বাবা-মা’কে তাদেরও নিজেদের ঘরেই দরজা আটকে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো।
সঙ্গত কারণেই গোটা ভারতে এখন প্রশ্ন উঠছে: সব ধর্ষণ বা সব ধর্ষণের নারীর একই মাপের মনোযোগ, সহানুভূতি, ভালোবাসা বা জনসমর্থন পায় কি? তবে এখানেও ‘কিন্তু’ রয়েছে। যেমন, মনীষার এই ঘটনার পরপরই উত্তর ভারতে আরো দু’জন দলিত তরুণী ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন। তাদের ভেতর এক দলিত তরুণী ধর্ষণের শিকার ও খুন হয়েছেন আপন বর্ণেরই দুই যুবকের হাতে। আবার আর এক দলিত তরুণী ধর্ষণ ও খুন হয়েছেন দুই মুসলিম যুবকের হাতে। তাহলে? তাহলে কোন দিক থেকে এবং কিভাবে ঘটনাগুলোর বিচার হবে? নাকি মানব প্রজাতির দুই প্রধান লিঙ্গের ‘সবলতর’ লিঙ্গটি যেখানেই পাবে বা পারবে, সে ‘দূর্বলতর’ লিঙ্গটির উপর আক্রমণ চালাবে? কখনো জৈবিক ক্ষুধা মেটাতে, কখনো নিজের শ্রেষ্ঠত্ব/অহম/আধিপত্য জারি রাখতে আবার কখনো বা নিজের হীনমন্যতাবোধ বা নিরাপত্তাহীনতা কাটাতে?
বাংলাদেশের দিকেই তাকাই। ক’দিন আগে ১৪ বছরের একটি হিন্দু কিশোরীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে সম্মতি না পেয়ে তাকে খুন করে ফেললো প্রতিবেশী এক বখাটে তরুণ। কিন্তু এই ‘ইন্ডিভিজ্যুয়াল’ কেসে অন্তত: ধর্মের প্রসঙ্গ একারণে টানা যাচ্ছে না যে অসংখ্য মুসলিম কিশোরী বা তরুণীও প্রতিদিনই হত্যা বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। যে ঘটনা ঐ হিন্দু কিশোরীর সাথে এক মুসলিম তরুণ ঘটিয়েছে, তা কোনো মুসলিম কিশোরীর সাথেও ঘটতে পারতো এবং সত্যি বলতে প্রতিদিনই ঘটছে। সিলেটে বরের সাথে বেড়াতে বেড়িয়ে ধর্ষণের শিকার হলেন এক ‘বাঙ্গালী মুসলিম’ নারী, বরের জন্য হাসপাতালে রক্ত খুঁজতে বের হয়ে ধর্ষণের শিকার হলেন আর এক বাঙ্গালী মুসলিম নারী এবং ক’দিন আগে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে এক মানসিক প্রতিবন্ধী, আদিবাসী কিশোরীর বাসায় ঢুকে আট কি নয়জন বাঙ্গালী মুসলিম সেটেলার তার বাবা-মা’কে আটকে রেখে, মেয়েটিকে গণধর্ষণ করে। তবে জামার পেছনে রক্তের দাগ লাগা, ক্লান্ত যে পাহাড়ি মেয়েটির ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হচ্ছে, এটা সম্ভবতঃ আড়াই বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্য দুই মারমা বোন সেনাবাহিনীর জওয়ানদের হাতে ধর্ষিতা হবার সময় দুই বোনের ভেতরের এক বোনের ছবি। পুরনো ছবি নতুন ঘটনায় ভুলক্রমে শেয়ার হচ্ছে। সেই দুই মারমা বোনের কথা আমরা আর মনে রাখি নি যে ঘটনায় বাংলা বলতে না পারা এবং একারণেই হাসপাতাল ও আদালতে ভাল ভাবে স্বাক্ষ্য প্রদানেও অক্ষম দুই ধর্ষিতা বোনের পাশে দাঁড়ানো খোদ চাকমা রানী ও মারমা রাজকন্যা ইয়ান ইয়ান পর্যন্ত এমন বিরূপতার শিকার হয়েছিলেন যে একবার জান-মান বাঁচাতে রানী নিজেই কোনো হ্রদ বা নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন।
তারপরও অবশ্যই ধর্ষণে ধর্ষণে বা ধর্ষিতা ধর্ষিতায় আমাদের সমবেদনা বা শোক কি প্রতিবাদ প্রকাশের তারতম্য আছে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বা ভিকারুন্নিসা বিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের শিকার বা নির্যাতিতা হলে আমরা যতোটা সোচ্চার হবো, গার্মেন্টস কর্মী কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো এখানে ওখানে মরে পরে থাকলেও আমরা ততোটা নড়বো না। ভারতে গুজরাটের দাঙ্গায় ধর্ষণের শিকার বিলকিস বানু অনেক বছর পরে হলেও ন্যায়বিচার পেয়েছেন। বাংলাদেশে ২০০১ সালে নির্বাচনোত্তর দাঙ্গায় শ’য়ে শ’য়ে ধর্ষিতা সংখ্যালঘু নারীদের ঘটনায় একমাত্র পূর্ণিমার ঘটনা ছাড়া আর কোনোটিতে আদালতে মামলা পর্যন্ত হয়েছে কিনা জানা যায় না। আওয়ামি লীগ সরকারও নানা বিবেচনায় আর এগোয় নি। যুদ্ধাপরাধের বিচার করতেই এত কাঠ-খড় পোড়ানো তো সংখ্যালঘু নারীদের উপর গণধর্ষণের বিচার! আবার এটাও তিক্ত সত্য যে পরপর তিন টার্ম নানা ভাবে ক্ষমতায় থাকা বর্তমান সরকারের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতারাও ধর্ষণের ক্ষেত্রে ‘স্বাধীনতা বিরোধী ছাড়া যে কোনো ধর্ষণের বিচার হবে’ জাতীয় শিউরে ওঠার মতো বক্তব্যও হালে দিচ্ছেন। ছাত্রলীগ কাউকে অত্যাচার করলেই সেই আক্রান্ত পক্ষ ‘স্বাধীনতা বিরোধী?’ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের এই বক্তব্য যেমন ভয়ানক, একইরকম ভয়ানক কিন্তু। ২০০১-এর অসংখ্য ধর্ষণের শিকার, সংখ্যালঘু নারীকে নিয়ে এদেশের ‘বিবেকবান, নাগরিক, সুশীল, প্রগতিশীল’ অনেকের শীতল নিস্পৃহতা। বরিশালের ভোলার অন্নদাশঙ্কর গ্রামে (মূলত: একটি চর বা দ্বীপ এলাকা) ২০০১ সালের অক্টোবর মাসের কোনো এক দিনে বাইরে থেকে ট্রলারে করে পুরুষেরা গিয়ে সংখ্যালঘু নারীদের ধর্ষণ করে এবং সেদিন সাত থেকে সত্তরের কোনো নারীই বাদ যান নি বলে আশপাশের সংখ্যালঘু জনপদগুলোর অনেকে আজো স্বাক্ষ্য দেন, ঐ গ্রাম থেকে অনেকেই পরে দেশত্যাগ করেছেন। দেশত্যাগ করেছেন ঝালকাঠি, নলছিটি, মেহেন্দিগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, পাতারহাটসহ ২০০১-এ আক্রান্ত সংখ্যালঘু জনপদগুলোর অনেক পরিবারই। এটা গত বছরের মার্চে ইউএস এইডের একটি কাজে ঐ এলাকাগুলোয় ঘুরে জানতে পাই। কিন্ত এই যে এতো নারীর আক্রান্ত হবার কোনো মামলাই হলো না অদ্যাবধি, সেজন্য কি ভিকারুন্নিসা স্কুলে যে কিশোরীটি নির্যাতিতা হয়েছিলো, তার পক্ষে দাঁড়াবো না? হ্যাঁ, তারপক্ষেও অবশ্যই দাঁড়াবো। কিন্ত অপরাধী পরিমলের উপযুক্ত বিচারের পাশাপাশি এই যে প্রতিদিন অসংখ্য মাদ্রাসায় অসংখ্য মেয়ে শিশু ও ছেলেশিশু ধর্ষণের শিকার ও খুন হচ্ছে, সেই হত্যা ও ধর্ষণকারীদের কী হবে?
ভারতের প্রসঙ্গেই আবার ফিরি। কোনো ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশু কি কম যন্ত্রণা ও ক্ষতির শিকার হয়েছেন? ১৯৭৩ সালে অরুণা শনবাগ নামের ২৬ বছর বয়সী যে নার্স মুম্বাই হাসপাতালে রাতের শিফটে কাজ করার সময় পোশাক বদলানোর মূহুর্তে সোহান লাল বাল্মিকী নার্মে এক ওয়ার্ড এ্যাটেন্ডান্ট অরুণাকে অতর্কিত আক্রমণ করে পায়ুপথে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় না, কুকুরের চেন দিয়ে এই সেবিকার শ্বাসরোধ করায় তার মস্তিষ্কে অক্সিজেনের সরবরাহ কমে গিয়ে অরুণা জীবনের পরবর্তী দীর্ঘ অনেক বছর বেঁচে ছিলেন কোমায়। মৃত্যু অবধি আর চেতনা ফিরে পান নি। চল্লিশটি বছর হাসপাতালের বিছানায় অচেতন অরুণা তরুণী থেকে বৃদ্ধা হয়ে ২০১৫ সালে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন। এই ৪০ বছর নিয়মিত হাসপাতালের কোনো না কোনো সেবিকা অচেতন অরুণার পোশাক বদলে, গা মুছে, নাকের নলে বা ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইলে তরল খাবার পুশ করে তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আক্রমণকারী সোহান লাল বাল্মিকী (রামায়ণের মহাকবি বাল্মিকী নামটি হালের ভারতে যাদের পদবি, তাদের ‘দলিত’ই মনে করা হয়; বাল্মিকী নিজেও অন্ত্যজ বা শুদ্র ছিলেন) অভিযুক্ত হিসেবে কারারুদ্ধ হন।
১৯৯০ সালে হেতাল পারেখ নামে এক চৌদ্দ বছরের স্কুল বালিকাকে ধর্ষণ ও খুন করে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় নামের এক ব্যক্তি। কলকাতায় এই ঘটনাটি ঘটার পরে ২০০৪ সালে ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হয়।
১৯৯২ সালে ভারতের জয়পুরে ভানোয়ারী দেবী নামে নিম্ন বর্ণের নারীকে গণধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত পাঁচ ব্যক্তিকে জয়পুর আদালত ১৯৯৫ সালে বেকসুর খালাস দেয়। ভানোয়ারী দেবী রাজস্থানের ‘নারী উন্নয়ন প্রকল্পে’ কাজ করতেন।
১৯৯৬ সালে ভারতে আইন বিভাগের ছাত্রী প্রিয়দর্শীনী মাত্তুকে দিল্লিতে তার ফ্ল্যাটে ধর্ষণের শিকার ও শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ ঘটনায় তাঁর সহপাঠী ও এক প্রাক্তন, উর্দ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তার পুত্র সন্তোষ কুমার সিংকে প্রথমে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যের অভাবে ছেড়ে দেয়া হলেও পরে জনবিক্ষোভের মুখে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়।
এরপরই ঘটে ২০১২ সালের সেই পৃথিবী তোলপাড় করা দিল্লী বাস ধর্ষণের ঘটনা। ভারতে ‘নির্ভয়া’ বা জ্যোতি সিং নামে এক তরুণী ফিজিওথেরাপিস্টকে চলন্ত বাসে তিন তরুণের হাতে নির্মম খুন ও ধর্ষণের পর গোটা ঘটনার অবিশ্বাস্য নির্মমতায় চমকে গিয়েছিলো গোটা উপমহাদেশ। সেই ভয়ানক কাহিনী আমাদের সবার জানা। দিল্লীর এক সড়কে রাত ন’টায় পারিবারিক ভাবেই স্বীকৃত বাকদত্ত যুবকের সাথে সিনেমা দেখে জ্যোতি বাড়ি ফেরার পথে সিএনজি খুঁজছিলেন। তারিখটি ছিলো ২০১২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। জ্যোতির ‘পোশাক’ও ছিলো দিল্লীর কেতা-দুরস্থ, নাগরিক অভিজাত মেয়েদের তুলনায় যথেষ্ট ‘প্রাচ্যদেশীয়, সংযত।’ জিন্স বা শার্ট নয়, খুব সাধারণ সালোয়ার-কামিজ ছিলো তাঁর পরনে। তা’ সিএনজি খোঁজার সময় প্রায় ফাঁকা এক বাসের ‘ড্রাইভার-কন্ডাক্টর-হেল্পার’ মিলে ছ’জন যুবক এক রকম জোরাজুরি করেই জ্যোতি ও তাঁর ছেলেবন্ধুকে বাসে তুলে নেন। তারপরের ঘটনা মোটামুটি আমরা জানি। চলন্ত বাসের ভেতরেই ভয়ানক ভাবে ধর্ষণ করা হয় জ্যোতিকে। তাঁর ছেলেবন্ধুকে শীতের রাতে বলতে গেলে নগ্ন অবস্থায় ছুঁড়ে ফেলা দেয়া হয় রাস্তায়। নির্ভয়াকে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করেছিলো ছয় অভিযুক্তের ভেতর বয়সে তরুণতম একজন। লোহার রড দিয়ে মেয়েটির অন্ত্র ছিঁড়ে নেয়া হয়েছিলো। নির্ভয়াকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয় এবং তেরোদিনের মাথায় সে মারা যায়। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলো গোটা ভারত। আবার ধর্ষণকারীদের পক্ষেও দাঁড়িয়ে গেছিলো ‘অতিরিক্ত পলিটিক্যালি কারেক্ট’ কিছু বাম বা অতিবিপ্লবী। ধর্ষণকারীরা ‘দরিদ্র’ বা ‘দলিত’ অথবা ‘মুসলিম’ ইত্যাদি নানা বিবেচনায় ধর্ষণকারীদের পক্ষেও বক্তব্য দিতে শুরু করে ভারতের কিছু লেখক, বামপন্থী বা নারীবাদী এ্যাক্টিভিস্টও। ঘটনার তিন বছর পর ‘নির্ভয়া’র মা প্রথম জানান যে তাঁর মেয়ের নাম ছিলো ‘জ্যোতি সিং।’ জ্যোতি সিংয়ের ঘটনায় চারজন ফাঁসির দন্ডাদেশ প্রাপ্ত হলেও লোহার রড দিয়ে জ্যোতির অন্ত্র ছিঁড়ে ফেলে মৃত্যু তরান্বিত করা ‘নাবালক’কে সংশোধন হোমে পাঠানো হয় এবং তাকে ব্যবসা শুরু করার জন্য টাকা ও কিছু স্কিল ট্রেনিংও দেয়া হয়। ব্যবসা শুরুর টাকা ও স্কিল ট্রেনিং ধর্ষণ ও খুনের জন্য একরকম পুরষ্কারও বটে। কিছুটা ‘নাবালকত্ব’ ও কিছুটা ছেলেটির ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু’ পরিচয়ের জন্যও তার পক্ষে দাঁড়ায় প্রচুর ভারতীয় বাম এ্যাক্টিভিস্ট।
ধর্ষকের আসলেই যে ধর্ম বা শ্রেণি ভিত্তিক ক্যাটেগোরাইজেশন সবসময় করা যায় না তার একটি বড় প্রমাণ আবার ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ভারতে আট বছরের আসিফা ধর্ষণের কাহিনীটি। এতই বেদনা জাগানো, ধর্মের নামে বিবমিষা জাগানো ঘটনা যে বলার নয়! আট বছরের আসিফা তার ঘোড়া পালক বাবার কাজে সাহায্য করতে গিয়ে বনে হারানো ঘোড়া খুঁজতে বা পারিবারিক ঘোড়া চড়াতে গিয়েই উত্তর ভারতের কাঠুয়ায় একটি মন্দিরে তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে কিছু পুরুষ। মন্দিরের পূজারীসহ কয়েকজন তাকে টানা ধর্ষণ করে। ধর্ষণ করার আগে আসিফাকে দিয়ে পূজা করানো হতো এবং শেষমেষ এক সপ্তাহ ব্যাপী ধর্ষণের পর আসিফাকে শ্বাসরোধ করে, পিটিয়ে এবং পাথর দিয়ে ছেঁচে হত্যা করা হয়। ঠিক আইএস যেমন ইয়াজিদি মেয়েদের ধর্ষণ করার আগে রোজ তাদের নামাজ পড়াতে বাধ্য করতো অনেকটা সেরকম কায়দা! আসিফা হত্যায় অবশ্য দ্রুতগতিতেই মামলা চলেছে ও বিচার হয়েছে। তবে আসিফা হত্যা ও ধর্ষণের কিছুদিন পরেই একটি হিন্দু বা জৈন বালিকাকে (৬/৭ বছরের) গণধর্ষণ ও হত্যা করে একাধিক মুসলিম যুবক যা নিয়ে তেমন আলোচনাও হয় নি। ধর্ষণকে ধর্ম বা জাতি প্রশ্নের সাথে তাই জড়িত করতে হলেও সবসময় সেটাই একমাত্র প্রতিপাদ্য কিনা সে ধোঁয়াশাও তাই রয়েই যাচ্ছে।
এবছরের শুরুতেই ভারতের হায়েদ্রাবাদে ২৭ বছরের এক ভেটিরানারী ডাক্তার তরুণী শহরের একটি দরিদ্র ও সংখ্যালঘু অঞ্চলে গিয়ে কাজ করে ফেরার সময় তার স্কুটি নষ্ট হয়ে যায় এবং তখনি তাকে ঘিরে আক্রমণ করতে আসা আক্রমণকারীদের দেখে ভীত মেয়েটি বাসায় ফোন করে বড় বোনকে আশঙ্কা ব্যক্ত করে যে সম্ভবত: সে আর বাঁচবে না। হায়েদ্রাবাদের ‘সেক্যুলার ও পলিটিক্যালি কারেক্ট’ সরকার শুরুতে চার ধর্ষণকারীর নাম বদলে হিন্দু নাম হিসেবে প্রকাশ করে। তাতেও জনরোষ কমে না। পুলিশ এই চারজনকে এনকাউন্টারে দিলে ভারতের বাম এ্যাক্টিভিস্টরা তখন চার ধর্ষণকারী ‘সংখ্যালঘু’ বলে এনকাউন্টারের শিকার জাতীয় বক্তব্য ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রদান শুরু করে। বলতে গেলে ভারতের ‘সেক্যুলার’ মিডিয়া তখন একরকম বিড়ম্বনায় পড়ে। ধর্ষকের নাম প্রকাশ না করলে বা নাম বদলে দিলে যদিবা রক্ষা, এনকাউন্টারে দিয়ে আর এক বিপদ।
যে কোনো অত্যধিক ‘পলিটিক্যাল কারেক্টনেসে’র সমস্যা হলো একটা সময় এটা নিজেই ভয়ানক ‘ইনকারেক্ট’ হয়ে ওঠে। ঠিক যে কারণে বিএনপি-জামাতের থেকে নানা ভাবেই আজো ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ আওয়ামি লীগ শুধুই ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র কথা বলে ছাত্রলীগের সব অন্যায়কে ঢাকা দিতে পারছে না, একইভাবে অবশ্যই বর্ণবাদী ভারতে যেখানে দলিত নারী ধর্ষণের ঘটনা চাপা দিতে তাকে পুড়িয়ে মারা হয় কিম্বা ফুলন দেবী এক জীবনে আর শান্তি বা সুবিচার পান নি, সেই ভারতেও ক্রমাগত ভাবে ধর্ষক ‘দলিত’ বা ‘মুসলিম’ হলেই বাম বা নারীবাদী এ্যাক্টিভিস্টদের সেটা চেপে যেতে হবে, জেএনইউ-যাদবপুর-এনডিটিভির এই অত্যধিক ‘পলিটিক্যাল কারেক্টনেস’ও নিজের অজান্তে একসময় ‘ইনকারেক্ট’ হয়ে ওঠে এবং সেদেশের দক্ষিণপন্থাকেই উল্টো প্রশ্রয় দেয় ও জোরালো করে। একদিক থেকে ভারতের বামরা যে খুব ভুল সেটা নয়। দলিত নারীকে ধর্ষণ করা হলে পুড়িয়ে মারবে বা ফুলন দেবীর সাথে অন্যায় হয়েই চলবে, তবে জ্যোতি সিংয়ের বা ভেটিরিনারি ডাক্তার প্রিয়াঙ্কার ধর্ষক মুসলিম বা দলিত হলেই কঠোর শাস্তি কেনো? সমাজে ক্ষমতাশীল শ্রেণির পাল্লা এমনিতেই ভারি হয়েই থাকে। যেকারণে ভিকারুন্নিসার ঘটনায় পরিমলের কঠোর শাস্তি হলেও হাজার হাজার মাদ্রাসা ছাত্র-ছাত্রীর খুন-ধর্ষণের বিচার নেই। তবে এই ‘পলিটিকাল কারেক্টনেসে’র নামে খোদ ধর্ষণের পক্ষে যেন সাফাই না গাওয়া হয়! চৌদ্দ বছরের কিশোরী হেতাল পারেখের ধর্ষক ও খুনী ধনঞ্জয়ের পক্ষে বিশাল প্রবন্ধ নামানোর পেছনে কি যুক্তি আছে কে জানে? ধর্ষকের পক্ষে এজাতীয় সাফাই পড়তে মেয়েদের শুধু তীব্র অস্বস্তি বা ক্ষোভ হয় এই যা! ধর্ষকের পক্ষে ভারতীয় বামরা প্রায়ই লেখেন-টেখেন। এখন সাদা প্রভুর হাতে কালো আফ্রিকান ক্রিতদাসীর ধর্ষণ অন্যায় ত’ বটেই, পাল্টা শোধ নিতে কালো পুরুষ সাদা নারীকে ধর্ষণ করলেই সেটা কি সিদ্ধ হয়ে যায়? রিক্সাঅলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে অশালীন কথা বললেই সেটা ‘ন্যায়যুদ্ধ’, বিষয়টি ঠিক এমনও নয়।
যাহোক, পৃথিবীর প্রতিটি হত্যা বা প্রতিটি ধর্ষণ যেন আমরা সমান ক্রোধ, নির্যাতিতের পক্ষে সমান আবেগ ও উত্তাপ দিয়ে নিরূপন ও বিচার করতে পারি, প্রকৃতি সেই শক্তি আমাদের দিক। মুখে বলা সহজ হলেও কাজটি করা কঠিন। তবু করতে তো হবে। নইলে এই ধর্ষণ উপত্যকাই আমার উপমহাদেশ হয়ে থাকবে অনন্তকাল। আর অবশ্যই বর্ণাশ্রমবাদী ভারতে একজন জ্যোতি সিংয়ের ঘটনায় কিছুটা যদি বা বিচার হয়ও, একজন মনীষা বাল্মিকীর দেহ খোদ পুলিশ পুড়িয়ে ফেলবে আলামত ঢাকা দিতে, এটাই ভবিতব্য।