দিনা ফেরদৌস

আমেরিকা প্রবাসী। লেখালেখির পাশাপাশি ছবি আঁকেন জল রঙে।

প্রতিটি শিশুই এই পৃথিবীর সন্তান

এই বিজ্ঞানের যুগে যদি বলা হয় শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর সংমিশ্রণ ছাড়াই যজ্ঞ করে বা ঐশী বাণীর বলেই বাচ্চা জন্ম নিতে পারে, তো যেকোনো ধর্ম বিশ্বাসীই তা বিশ্বাস করবে না। বাচ্চা যে বাতাসে হয় না তা এখন সবাই জানে। কেউ না কেউ জন্ম দেয় বলেই দুনিয়ায় জনসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বরং কে জন্ম দিচ্ছে, কোথায় জন্ম দিচ্ছে, সেই বাচ্চা ইচ্ছায়, নাকি অনিচ্ছায় না বুঝে জন্ম দিচ্ছে মা, যেই বাচ্চা দুনিয়ায় আসছে তার যত্ন, দেখাশোনা ঠিকঠাক হবে কি না সেটাই ভাবার বিষয়। 

বনে মৃগয়া করতে গিয়ে রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলার প্রেমে পড়ে তাকে গান্ধর্ব মতে বিয়ে করে প্রাসাদে ফিরে যান শকুন্তলাকে বনে রেখে। রাজা দুষ্মন্তের ফিরে আসার অপেক্ষা করতে করতে শকুন্তলা নিজেই একদিন রাজার খোঁজে প্রাসাদে গেলে বুঝতে পারেন রাজা তাকে ভুলে গেছেন, অপমানে শকুন্তলা ফিরে আসেন বনে। বহুদিন পর রাজা জানতে পারেন শকুন্তলার ঘরে ভরত নামে তার এক সাহসী ও শক্তিশালী ছেলে আছে, যেই ছেলের খেলা হচ্ছে, 'সিংহকে হাঁ করিয়ে তার দাঁতকপাটি গোনা'। সঙ্গে সঙ্গে শকুন্তলাকে তার বউয়ের মর্যাদা দিয়ে প্রাসাদে নিয়ে যান (কারণ রাজার সব সময়ই দরকার তাগড়া পুত্র সন্তানের। ফলে বিয়ে কিভাবে হয়েছিলো কিংবা বউ কে ছিলো তার থেকেও বড় বিষয় ছিলো সন্তান পাওয়া)।

রাজা দশরথকে দেখা যায় অনেক বছর বাচ্চা না হওয়ায় যজ্ঞ করে চার পুত্রসন্তানের বাবা হন। অন্যদিকে রাম রাজাকে দেখা যায় প্রাসাদে বউকে নিয়ে বারো বছর সংসার করেও যেখানে বাচ্চা জন্ম দিতে পারেননি, সেখানে বনবাসে গিয়েই রাবনের কাছ থেকে বউ উদ্দারের পর একা প্রাসাদে ফিরে যাবার পর জানতে পারেন আশ্রমে তার যমজ ছেলে সন্তানের জন্ম হয়েছিলো। তিনি তাদের প্রাসাদে নিয়ে আসেন।

                                                               ছবি- ইন্টারনেট থেকে

বাচ্চা জন্ম যে কোনো নারী দিতেই পারে, কথা হচ্ছে কে জন্ম দিয়েছেন, আর কোথায় বাচ্চা বড় হয়ে উঠছে। রাস্তার পাগলীও বাচ্চা জন্ম দেয় না বুঝে, যার বেশিরভাগই পালিত হয় অবহেলায় কখনো মারাও যায় অযত্নে। তাদের বাপের পরিচয় তো কেউ জানতে চায় না, কোন ভদ্রলোক অথবা ভয় পেয়েও হতেও পারে, কি জানি নিজের পরিচয় বের হয়ে আসে কিনা।

খ্রিষ্টীয় ধর্মমতে গেলে জেসাস বা মুসলিম ধর্ম মতে গেলে ঈসা (আঃ) এর জন্ম নিয়েও কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই। খৃষ্টীয় ধর্মমতে বলা হয় ঈশ্বরের পুত্র, যা মুসলিম ধর্মে শীরক হিসেবে দেখা হয়। তবে একটা জায়গায় মিল হচ্ছে, তা হলো তিনি পরিচিত ছিলেন মরিয়ম পুত্র বা মাতা মেরির পুত্র হিসেবে। ঈসা(আঃ)কে বলা হতো, ঈসা ইবনে মারিয়াম (মানে মরিয়মের পুত্র ঈসা, সেই হিসেবে)। তিনি মায়ের নামেই পরিচিত। কই তিনার তো ইজ্জত যায়নি বা জন্ম নিয়েই তিনি পগম্বর হয়ে যাননি। উনার কর্মই তাঁকে চিনিয়ে দিয়েছিলো।

                                                                    ছবি-ইন্টারনেট থেকে

মায়ের নামে পরিচিত হলেই কোনো সন্তানের ইজ্জত চলে যায় না। সন্তানের উপর বরং মায়ের অধিকারই বেশি থাকার কথা, কারণ মায়ের শরীরে ধীরে ধীরে বাচ্চা বড় হয়ে উঠে। কোনো নারী তার গর্ভে বাচ্চা নিবে, কি নিবে না সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত। কথা বলার জায়গা বরং সেখানে, যেখানে জোর পূর্বক ধর্ষণের মাধ্যমে বাচ্চা জন্ম দেয়া হয়, রাস্তার পাগলীকে যে কিছুই বুঝে না, তাকে বাচ্চা জন্মদানে বাধ্য করা হয়। লজ্জা শরমের কিছু যদি থেকে থাকে, তো সেখানেই করা উচিৎ।

পরীমণি মা হচ্ছে, এইটা এমন বড় কোনো খবর নয় যে এতো মাতামাতি করতে হবে। বরং যারা  পরীমণির বাচ্চার বাপ হওয়ার দরকার মনে করবে, সে পরীমণিকে তেলাবে। আমাদের পরীমণির বাচ্চার বাপ খোঁজার দায়িত্ব না নিলেও চলবে। পরীমণি নিজের নামেই পরিচিত, টাকা পয়সারও অভাব নেই, সে নাবালিকা কিংবা পাগলও না যে, বাচ্চার যত্ন নিতে সমস্যা হবে। সে তো ঠেকায় পড়েনি অথবা স্বীকৃতিও চায়নি কোন পুরুষের কাছে যে, তার আগত  বাচ্চার বাপের পরিচয় দিতে হবে, যেমন বিচলিত হচ্ছেন আপনারা। সে বিয়ের খবরের আগে বাচ্চার খবর জানিয়েছে, কারণ বিয়ের সাইনবোর্ড তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখন পরীমণিকে খারাপ বলতেই পারেন সামাজিকভাবে। কিন্তু যাকে এতো খারাপ বা তুচ্ছ মনে করেন, সেই তার পিছনেই কেনো এতো সময় নষ্ট করছেন দিন-রাত তার পিছনে লেগে থেকে। গালি দেন ভালো কথা, কিন্তু উপেক্ষা করতে পারছেন কি? সেই পরীই তো আপনাদের মাতিয়ে রেখেছে।

এখন কেউ কেউ বলবেন, এতে সমাজে বাজে প্রভাব পড়ে, এইসব দেখে অন্যরাও শিখবে। তারমানে দাঁড়ালো, ঘুরে ফিরে গালি দিয়ে লোকজন সেই পরীকেই ফলো করে, পরীর জীবন যাপন থেকেই শিক্ষা নেয়, উৎসাহিত হয়। অথচ চারিদিকে, ইউটিউবে কি সুন্দর সুন্দর ওয়াজ মাহফিল হয়, মানুষ কি সুন্দর ধর্ম ও নৈতিকতার কথা বলে, এরাই নাকি নায়িকাদের লাইফ স্টাইল দেখে নিজেকে চালনা করে। তো কি দরকার ওইসব নৈতিকতার বাণী শুনিয়ে? বাপছাড়া বাচ্চাজন্ম দান যদি আইনত কোন বাধা সৃষ্টি না করে তো কারো কিছু বলার নাই, বিশেষ করে যাদের মগজে সব সময় পরীমনি কামড়ায়। পরীমনির নিউজ যারা খুঁজে বের করে পড়েন। 

অবশেষে পরীমনিকে নিয়ে সমালোচনা করে আপনি সতীলক্ষ্মী যেমন হবেন না, তেমনি চরিত্রবানের সনদও পেয়ে যাবেন না। পরীমনির সাথে আপনাদের পার্থক্য সে নিজের জন্যে শুধুই মা হতে চাচ্ছে বা বাচ্চা জন্ম দিচ্ছে আর আপনাদের অনেকেই বাচ্চা জন্ম দেন সংসার ধরে রাখতে, স্বামী বা স্ত্রী ধরে রাখতে। মনে রাখবেন, মানব জন্ম মানব জন্মই তা যেভাবেই হোক। ব্যক্তির জন্ম যথা তথা হতেই পারে, তবে কর্মটা ভালো হওয়া জরুরি। যে শিশু পৃথিবীতে আসছে তাকে বাপের পরিচয় দিয়ে নয়; বরং মানুষ হিসেবে কাজে কর্মে যেন নিজের পরিচয় তুলে ধরতে পারে সেটাই কামনা করা উচিৎ।

কবি 'সুকান্ত ভট্টাচার্য' অনেক আগেই লিখে গেছেন-

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে

                 চলে যেতে হবে আমাদের।

চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

      প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার"।

1556 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।