দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত

চিকিৎসক দোলনচাঁপা একজন কথা সাহিত্যিক। কিশোর কাহিনী, কল্পবিজ্ঞান লেখায় রয়েছে তাঁর রয়েছে মুন্সিয়ানার ছাপ। একাধিক সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত দোলনচাঁপা'র প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস "চন্দ্রতালের পরিরা"।

প্যানডেমিক ডায়েরি-০২ (ফাইনম্যান)

"আসুন স্যার। দাঁড়ান, অন্ধকার। মোবাইলের টর্চটা জ্বালাই।" অজিতেশ অবাক। এমন ঘুপচি সিঁড়ি দিয়ে মানুষ চলাফেরা করতে পারে?

কিন্তু কী করবে! দেহোপজীবিনীর সস্তা ডেরায় আসতে গেলে তো অন্ধকার গলিগালা পেরোতেই হয় খরিদ্দারদের। সে না হয় এসেছে অন্য কাজে। সঙ্গে স্ত্রী। দু‘জনেই ডাক্তার। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ের কথা আলোচনা করতে করতেই পায়েলের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছিলো। "হ্যাঁ গো, ওদের চলবে কীভাবে?"

শহরের বিখ্যাত এন্ডোক্রিনোলজিস্ট অজিতেশ। রোগীর অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির হাল হকিকত বুঝে ফেলে মুহূর্তে।কিন্তু স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলো না। দিনের মধ্যে পঞ্চাশবার হাত ধুচ্ছে, স্যানিটাইজার মাখছে ভাইরাসের ভয়ে। সংক্রমণের ভয়ে এখন যৌনকর্মীদের কাছে কেউ আসবে না। না খেতে পেয়েই ক্রমশ মরে যাবে ওরা। নিশ্চুপে। খিদে না ভাইরাস কোনটা বেশি খতরনাক গুলিয়ে গেলো অজিতেশের।

পায়েল একরোখা। একবার মাথায় ঢুকেছে মানে যাবেই। "ছাড়ো তো! ওসব এনজিও মারফত টাকা দেওয়ার মানে হয় না। নিজেরাই যাই চলো। হাজার পাঁচেক টাকার চাল ডাল আর কিছু ওষুধ, মাস্ক।"

এতকাল 'ফেমিনিস্ট' বলে বন্ধুবৃত্তে যারাই পায়েলকে গালি দিতো, কী এক মন্ত্রবলে রাজি হয়ে গেলো। ছ'জনের মেডিক্যাল টিমকে আগলে নিয়ে গেলেন লোকাল সাব ইন্সপেক্টর অভীক মুখার্জি। কে বলবে পুলিশের মানবিক মূল্যবোধ নেই! পুরনো ধ্যানধারণাগুলো দুমদাম ভেঙে দিচ্ছে করোনা।

নাহ, সেলফি তোলে নি ওরা। যীশু বলেছিলেন, ডানহাতে এমনভাবে দান করবে যেন বাঁহাত না জানতে পারে। কাকে দেখাবে বদান্যতা? কী লাভ?

মোটামুটি জনা পঞ্চাশেক মহিলাকে মাস্ক পরা শিখিয়ে বেরিয়ে আসার সময় একটা দৃশ্যে চোখ আটকে গেলো সবার।

খোলা চৌকোনো চাতালে কড়া রোদ। হাত নেড়ে নেড়ে, জোর গলায়, বই পড়ে শোনাচ্ছে একটি মেয়ে। বছর বারো তেরো হবে। সামনে জনা দশেক ছেলেমেয়ে নিশ্চুপে বসে শুনছে আর মাঝে মধ্যে হেসে উঠছে। ইন্সপেক্টর অভীক মৃদু হাসলেন।

"এদের বাচ্চারা, লকডাউনে যাবে কোথায়? স্কুল বন্ধ । ঐ একটু গালগপ্পো -" অজিতেশ ইশারায় থামিয়ে দিলো অভীককে।

কয়েকটা শব্দ তার কানে এসেছে 'ফাইনম্যান', 'ম্যানহাটন।' স্ট্রেঞ্জ! পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো অজিতেশ। নীল ফুলছাপ প্রিন্টের ফ্রক পরা মেয়েটি চুপ করে গেলো তখনই।

"থামলে কেন?" মেয়েটি চুপ। "গল্পের বই?" মিষ্টি হেসে ঘাড় নাড়লো মেয়েটা। "আজ তো রিচার্ড ফাইনম্যানের জন্মদিন।"

অজিতেশের মুখ দিয়ে মিনিট খানেক কথা সরলো না। "ফাইনম্যান?" দর্শকদের মধ্যে থেকে জবাব এলো , "ম্যাজিকের লোক।" "তোর মুন্ডু, উনি বিজ্ঞানী।" "এ বাবা! তুইই তো বললি উনি শক্ত শক্ত তালা খুলে ফেলতেন যাদু দিয়ে।" "দূর গাধা! উনি এমন বুদ্ধিমান ছিলেন যে সব লকারের কোড ক্র্যাক করতে পারতেন। "আলিবাবা চিচিং ফাঁক বললে যেমন দরজা খুলে যেত?"

একপ্রস্থ কুলকুল হাসির মধ্যে অজিতেশের কানে এলো মেয়েটার গলা। "বিজ্ঞানীরা সব পারে, বুঝলি। উনি বলেছিলেন, বিজ্ঞানের হাতে একটাই চাবি। সেটা দিয়ে যেমন স্বর্গের দরজা খোলে, নরকের দরজাও খোলে। তবে কোন দরজাটা যে স্বর্গের আর কোনটা নরকের সেটা মানুষ এখনও জানে না।"

"তাহলে ?" অজিতেশ বিমূঢ় ।

"প্রশ্ন হলো আমরা কি এই চাবি ছুঁড়ে ফেলে দেবো আর স্বর্গে যাওয়ার রাস্তাটা বন্ধ করে দেবো একদম ? নাকি আরও চেষ্টা করে যাবো কীভাবে এই চাবির সব থেকে ভাল ব্যবহার করা যায়? এটাই ফাইনম্যান জিজ্ঞাসা করেছিলেন।।" পায়েল বলে উঠলো, "বিজ্ঞানের চাবিটাকে খুঁজে বার করতেই হবে।"

মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। "আমরা খুঁজতে বেরোব ঠিক করেছি। লকডাউনটা উঠুক। ইস্কুল বন্ধ। আমাদের একটা কম্পিউটার কিনে দেবে আন্টি? পুরনো হলেও ইটস্ ফাইন।"

2103 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।