আমাদের সমাজে যৌনতায় নারীর সম্মতি কে গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছে যুগের পর যুগ ধরে। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে এখনো সমাজের একটা বিরাট অংশের মনে যৌনতা নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা গেঁথে আছে, যার বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে কলমযুদ্ধ চলছে।
আমাদের যত ভুল ধারণা-
১। নারীটি আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত, সে যার তার সাথে যৌনতায় আগ্রহী
২। নারীটি রাত করে বাড়ি ফেরে, সে বহু মানুষের সাথে যৌনতায় লিপ্ত
৩। নারীটি ক্যারিয়ারে সফল, নিশ্চয় সে যৌনতার বিনিময়ে সুবিধা ভোগ করে
৪। নারীটি কপালে বড় টিপ পরে, সে যৌনতায় আগ্রহী
৫। নারী ধূমপানে কিংবা মদ্যপানে অভ্যস্ত, তাকে নিয়ে যে কেউ বিছানায় যেতে পারে
এরকম আরো শত শত...
যৌন সম্মতি হলো দু‘জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের স্বেচ্ছায় যৌনতায় অংশগ্রহণ। নারীটির সম্মতি হতে হবে তার সুস্থ এবং সচেতন অবস্থায়। যৌনতায় কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর ও যেই মূহুর্তে নারীটি অস্বীকৃতি জানাবে সেই মূহুর্তে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে থেমে যেতে হবে। নারীটির না বলার পর ও যদি দ্বিতীয় ব্যক্তি তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে তবে সেটা ধর্ষণ। বিবাহিত দম্পতিদের ও যৌনতায় বারবার একে অপরের সম্মতি নেয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। এক্ষেত্রে সমস্যা হয়, আসলেই ধর্ষণ ঘটেছে কীনা তার নির্ণয়ে। দু‘জন মানুষ এর মাঝে একজন যদি দাবি করেন আমি সম্মত ছিলাম না, তখন তার বিবৃতিকে যথাসম্ভব গুরুত্ব দেয়ার কথা।
আজকে এই কথাগুলো আবার নতুন করে লেখার উদ্দেশ্য হলো আজ ধর্ষণের সহযোগী হিসেবে উঠে এসেছে এমন একজনের নাম যিনি নিজে ইতোপূর্বে ধর্ষণ বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে সমাবেশে অংশ নিয়েছেন, নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিম্ন আয়ের নারীদের মাঝে সেনিটারি প্যাড বিতরণের কাজ করেছেন। মার্জিয়া প্রভা, একজন নারীবাদী এবং এক্টিভিস্ট হওয়ার সুবাদে তার সাথে আমাদের ধর্ষণ আর পারস্পরিক সম্মতিতে যৌনতার মাঝের পার্থক্য নিয়ে আলাপ হওয়ার কথা ছিলো না। এগুলো খুব মৌলিক ধারণা। কিন্তু একজন নারীবাদী মার্জিয়া প্রভা, রেইপ এপোলজিস্ট হিসেবে আবির্ভূত হন, যিনি একজন নারীর তার বন্ধুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনার পর ও সেই বন্ধুর সাথে ট্যুরে যাওয়ার মতো রুচি ধারণ করেন এবং ভিক্টিম নারীটির উপর বারবার মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করতে থাকেন, তখন আমাদের আবার শুরু থেকে ভাবা প্রয়োজন হয়। তখন আমাদের একই কথাগুলো আবার বলার দরকার হয়। এই যে বন্ধু ধর্ষক প্রমাণিত হওয়ার সুবাদে ধর্ষণ কে ধর্ষণ বলতে রাজি না হওয়া, ক্রমাগত ভিক্টিমকে হ্যারাস করা এবং ধর্ষককে বাঁচানোর নির্লজ্জ প্রয়াস আমরা দেখতে পেলাম এটা ঘৃণ্য এবং নোংরা একটি ঘটনা।
ঘটনার বিবরণ সকলের সামনে আনেন মাহমুদ এইচ খান, যিনি সংবাদ২৪ নামক একটি অনলাইন পোর্টালের সম্পাদক। গত ৩ আগস্ট মাহমুদের বাসায় ভিক্টিম নারী, ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত সজীব তুষার, তার বন্ধু এবং মৌলভীবাজারের একজন বাম নেতা রায়হান আনসারী এবং রায়হান আনসারীর প্রেমিকা মার্জিয়া প্রভাদের একটি জমায়েত হয়। ভিকটিম নারী, ধরে নিই তার নাম, ক। মাহমুদের বাসায় প্রভা রায়হানরা ইতোপূর্বেও জমায়েত হয়ে পার্টি করেছে। ক সেদিন ই প্রথম ওই আসরে যায়। ক এবং অভিযুক্ত সজীব তুষার ছোটবেলার বন্ধু ছিল। ক জানিয়েছেন, তিনি উইড জোগাড় করে দিতে বলেছিলেন। বন্ধু সজীব তুষার তাকে জানায় উইড খেতে হলে রাতে বাইরে থাকতে হবে, এনে দেয়া যাবে না। সেই মতো সেদিন মাহমুদের বাসায় তারা যায়। সজীব তুষার ছিলো রায়হান আনসারী এবং প্রভার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রভার বক্তব্য, সে জানতো তাকে জায়গা করে দিতে হবে। এর পর ওই ঘরে দু‘জন এডাল্ট মানুষ কী করলো সেটা সে দেখার প্রয়োজন মনে করে নি। অথচ মেয়েটি জানাচ্ছে সে বারবার আপত্তি জানিয়েছিলো। একবার ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে আসলেও পরবর্তীতে ধর্ষক তুষার তাকে আবার ভেতরে নিয়ে দরজা আটকে দেয়। উইড খাওয়ার কারণে তার শরীর মনের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সে প্রতিরোধ করতে পারে নি শক্তভাবে।
ধরে নিলাম, সেদিন প্রভা বুঝতে পারে নি যে মেয়েটির সম্মতি ছিলো না। পরবর্তীতে মেয়েটি যখন অভিযোগ জানালো, তখন একজন এক্টিভিস্ট হিসেবে তার উচিত ছিলো মেয়েটিকে ভিক্টিম হিসেবে বিচার পাবার সব রকম সুযোগ করে দেয়া। কিন্তু প্রভা তা করেন নি। উলটে ক্রমাগত একটি মেসেঞ্জার গ্রুপের কনভার্সেশনে এটাকে দু‘জনের সম্মতিতে যৌনতা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছেন। তার প্রেমিক মেয়েটিকে জিম করা মেয়ে অথচ ধর্ষককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কেনো দেয় নি বলে জানতে চায়, যা প্রকারান্তরে ভিক্টিম ব্লেমিং। একজন বামনেতা রায়হান আনসারী, একজন এক্টিভিস্ট মার্জিয়া প্রভা, বহুদিনের উইড সেবনকারী হিসেবে এটুকু জানা থাকার কথা ছিলো যে মেয়েটির সে সময় প্রতিরোধ শক্তি না থাকার ই কথা। আর শুধু জিম করলেই একজন ধর্ষককে প্রতিহত করা যায় এমন গাঁজাখুরি বক্তব্য দেয়া রায়হান আনসারীর কথার কোনো প্রতিবাদ করতে দেখা যায় নি মার্জিয়া প্রভাকে। উলটে এখনও পর্যন্ত প্রভাকে ভিক্টিম মেয়েটি এবং ঘটনা সামনে আনার জন্য মাহমুদ এইচ খান এর প্রতি বিভিন্ন অভিযোগ আরোপ করতে দেখা গেছে। প্রভা একটি গ্রুপ কনভার্সেশনে মাহমুদ কে বলেছে, তুমি যেভাবে খেলতে নামছ আমরাও সেভাবে খেলবো! ওয়াও, প্রভা, আপনি একটা মেয়ের সাথে এত বড় অন্যায়ের পর এটাকে খেলা হিসেবে নিচ্ছেন! এটা আপনার কাছে খেলা! তাই বুঝি আপনার নানান রকম ছলের দরকার পড়ছে।
ঘটনা সামনে এনে মাহমুদ খুব ই অপরাধ করে ফেলেছেন। মাহমুদ এটি ব্যক্তি স্বার্থে করেছেন। কারণ মাহমুদের বাসায় মদ গাঁজার আসর বসেছিলো, একটি মেয়ে সেখানে ধর্ষিত হয়েছে একথা সামনে আনলে সমাজ এবং আইন মাহমুদকে খুব ই খাতির যত্ন করবে। মাহমুদ সেই খাতির যত্নের লোভ এড়াতে পারে নি। লোভ সামলাতে না পেরে প্রভার মতো নিবেদিত প্রাণ রেইপ এপোলজিস্ট এক্টিভিস্টএর নামে মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন মাহমুদ। ঘটনাটি প্রভা, রায়হান এবং ধর্ষক তুষার মিলে নিজেরা সভা বসিয়ে সালিশের মাধ্যমে সমাধান করতে পারতো। আফটার অল, ধর্ষণের সালিশ বিচার সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার জন্যই নিশ্চয় তারা এতদিন এক্টিভিজমের মুখোশ পরে ঘুরেছেন।
মুখোশধারী এইসব মানুষকে চিনে নেয়ার সময় এখনই। একজন এক্টিভিস্ট হবার সুবাদে কেউ যেন এভাবে আর কারো ক্ষতি করতে না পারে তাই এই ঘটনার সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া ভীষণ জরুরি।
ক কে আমার আন্তরিক ভালবাসা এবং শুভকামনা। অনেকটা কঠিন পথ অপেক্ষা করে আছে আপনার জন্য।