'সেই সত্য যা রচিবে তুমি
ঘটে যা তা সব সত্য নহে'
মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা যেন ঘটনার কুরুক্ষেত্রের ভেতর রয়েছি। এত এত ঘটনার ঘনঘটা! কী ভীষণ এসবের গতি, কী ভীষণ অভিঘাত এসব ঘটনার। একের পর এক সব অসম্ভব ঘটনা ঘটে চলেছে চারপাশে। প্রায়ই মনে হয় এসব ঘটনার তীব্রতা যেন আমাদেরকে স্বাভাবিক মানবিক মানুষ হিসেবে থাকতে বাধাগ্রস্ত করছে।
প্রায় ২ বছর ধরে কোনো রকম আগাম প্রস্তুতি ছাড়াই একেবারে হঠাৎ করেই কোভিড যুদ্ধে সামিল হতে বাধ্য হলাম আমরা সবাই। এক ধরনের বেসামাল অবস্থায় রয়েছি এখনো। তারই ভেতর ঘটে চলেছে একের পর এক মহাঅঘটন। অতিসম্প্রতি নায়িকা পরীমনিকে নিয়ে যা কিছু আমরা দেখছি মনে হচ্ছে মশা মারতে কামান দাগা'র প্রবাদটির সত্যতা আরও একবার আমাদের চোখের সামনে প্রমাণ করা হলো। কোনো ভয়াবহ জঙ্গি বা সিনেমায় যেমন দেখা যায় নৃশংস সিরিয়াল কিলারকে ধরে নেওয়ার সময় বিশাল কোনো সশস্ত্র বাহিনীর লোকজন নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার সাথে এসে চারদিকে ঘেরাও করে তাঁকে সাথে করে নিয়ে যায়, পরীমনিকেও এভাবেই নিয়ে যাওয়া হলো।
একটি সমাজের শিক্ষিত অশিক্ষিত সব মানুষকে কী বিচিত্র উপায়ে বোকা বানানো হয়। পরীমনি কী করেছিলো, কে বা কাদের আঁতে আঘাত লেগেছে, ওঁকে শায়েস্তা করতে পারলে কাদের স্বার্থ সিদ্ধি হয়, সেসব কথা পরে। কিন্তু এই ঘটনার ফলে যে আমাদের এই অশিক্ষিত বর্বর সমাজের ভদ্রলোক সেজে থাকা মানুষদের চিন্তা, মনন এবং অভিরুচির যে কুৎসিত বিকৃত রূপটি আমাদের সামনে নাঙ্গা মানুষের মতোই প্রকাশ পেয়ে গেলো তার কী হবে?
এই সমাজে মোড়লপনার ঠিকাদারী করা ক্ষমতাসীন পদ দখল করে রাখা মানুষের মতো দেখতে মানুষগুলো কিন্তু সুযোগ বুঝে উগ্রে দিলো তাদের সমস্ত ঘৃণার বমি। এসব মানুষদের মনের মধ্যে কতটা বিকৃতি, কতটা নির্মম প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে, তার কিছুটা অংশ তারা আমাদের সামনে প্রকাশ করলো পরীমণিকে (একটি নারীকে) বিপদে পড়তে দেখে। নারীর যেন দায় পড়েছে সমাজের সতীত্ব ধরে রাখার। নারী বাড়ীতে কাজকর্ম করবে, বাচ্চাকাচ্চা পয়দা করবে, ধর্মকর্ম পালন করে শরীরকে বস্তাবন্দি করে রাখবে, ধ্বজভঙ্গ পুরুষের বিছানার সঙ্গী হবে, পদে পদে অপমান, গালমন্দ আর অপবাদের শিকার হবে। এতটুকু করতে হলেই যদি হোতো তাহলে সমস্যা ছিলো না। কিন্তু এতে পুরুষ কিন্তু মোটেও সন্তুষ্ট নয়। তখন পুরুষের কমন ডায়লগ হচ্ছে বাসায় বসে বসে খাও আর ঘুমাও আর হিন্দি সিরিয়াল দেখা ছাড়া আর কী কাজটা করো? আবার এসব মহান পুরুষরাই বাসায় এসব ডায়লগ মেরে বাইরে গিয়ে অন্য নারীদের দেখে বর্তে যান। মনের জিভ দিয়ে লকলক করে লোল পড়তে থাকে। তবে এখনকার পুরুষরা কিন্তু আরও অনেক চালাক হয়ে উঠেছে। ওরা চায় নারী শুধু বাসার কাজ করবে সেটা ঠিক নয়, তাঁরা টাকা উপার্জনও করুক। কিন্তু সেখানেও বেশ কিছু বাঁধাধরা নিয়ম আছে। শিক্ষকতা করতে পারো, নার্স, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারো, সরকারী চাকরী করতে পারো, অল্প শিক্ষিত হলে গার্মেন্টসে, বাসাবাড়িতে কাজ করো। নাচ-গান, শিল্প-সংস্কৃতি, নাটক-সিনামা? নৈব নৈব চ! ওগুলো খারাপ মেয়েরা করে। ফলে তোমাকে ভদ্রমেয়ে হতে হবে। তোমার হাতে-পায়ে, মুখে-মনে, মগজে সেঁকল পরানো থাকবে কিন্তু তুমি তো নাদান বালিকা এতকিছু বোঝার দরকার নেই। তুমি রোজগার করবে ঠিক আছে তাই বলে কিন্তু তুমি স্বাধীন নও। তারপরও তোমাকে বাসাবাড়ি, বাচ্চাকাচ্চা সব একাই সামলাতে হবে আবার উপার্জিত অর্থ কোথায় খরচ করছো সেটাও জানাতে হবে পুরুষটিকে।
এছাড়াও রয়েছে মোরাল পুলিসিং। কী খাবে? কী পরবে? কোথায় বা কখন যাবে? সবকিছুর মোড়লপনার ঠিকাদারি থাকবে পুরুষতন্ত্রের হাতে। এইবেলা আর পুরুষ একা নন। এবারে সমাজের সতী নারীরাও এগিয়ে আসবে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রাখার বাহক হিসেবে। এইসব ভণ্ড নারীরা ইতিমধ্যে সমাজে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত অথচ নিজেদেরকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়েছে এমনসব মহীয়সী রমণীরা হা রে রে করতে করতে এগিয়ে আসবে। এরা পুঁজিবাদ, পুরুষতন্ত্র, সমাজ, রাষ্ট্র, দর্শন কিছুই বুঝবে না কারণ পড়াশোনা করার সময় বা ইচ্ছে কিছুই নেই। এরা বুঝবে অধিক সহজতর বিষয়, সেটা হচ্ছে ধর্ম। পৃথিবী গোল্লায় যাক এরা বেহেস্তে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। দুনিয়াকে দোজখ বানিয়ে এরা কবরের আজাব নিয়ে চিন্তা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
এসব ভেড়ার পালে যখন পুরো দেশ গিজগিজ করছে ঠিক তখনই কোনো একজন পরীমণি এসে তার ইচ্ছে স্বাধীন জীবন কাটাতে লাগলো। একজন পরীমণি যে একা একাই পরীমনি হয়ে উঠতে পারে না সেইদিকে আমাদের দৃষ্টি গেলো না। আমরা আবার সহজ পন্থা বেছে নিলাম। ওঁকে পাথর ছুঁড়ে মারা হোক, ওঁকে ফাঁসি দেওয়া হোক।
কিন্তু কথা হচ্ছে কেনো? কেনো আমরা তাঁর ন্যায়বিচার হোক সেটা চাইবো না? কেনো বারবার ক্ষমতাসীন মানুষরা যা ইচ্ছে তাই করবে? কেনো বারবার নারীকেই মোরাল পুলিসিং মেনে নিতে হবে? পরীমনি নাহয় নায়িকা কিন্তু এদেশের কোনো একটি নারী বা শিশু কেউ কী নিরাপদ? এত এত বস্তা পরে যেসব নারী- শিশু ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁরাও তো রেপড হচ্ছে, তাঁদেরকেও তো ইভটিজিং, বডি শেইমিং করা হচ্ছে। তারপর এখন বলা হচ্ছে রাত-বিরেতে যেসব নারী ঘোরাঘুরি করে তাঁরা হচ্ছে রাতের রাণী। হ্যাঁ তাহলে সব নারীদেরকেই রাতের রাণী হতে হবে। কার সমস্যা তাতে? একটি মাত্র শব্দ দিয়ে যদি পুরুষ মনে করে থাকে যে সে নারীকে বেশ জব্দ করলো, অবমাননা করলো তাহলে সেটা ভুল। পৃথিবীর কোনো শব্দ বা কোনো পেশাকে কিছুতেই অশ্রদ্ধার চোখে দেখা যাবে না। এই মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন।
পুরুষ যা করে চলেছে নারীর সাথে তাতেই বরং সমাজ সংস্কারের পথে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। নারীকে বুঝতে হবে তার অবস্থান কোথায় রয়েছে এই সমাজে। নারী যে নিজের চোখে এভাবে ঠুলি পরে আছে তাতে আসলে আখেরে কাদের লাভ হচ্ছে সেটাও কিন্তু নারীর এ বেলায় বুঝে নেওয়া দরকার। এই সমাজে নারীকে লক্ষ্মী মেয়ে সাজিয়ে রাখার যে চক্রান্ত সেটাকে সমূলে উৎপাদন করাও কিন্তু এখন নারীর একমাত্র লক্ষ হওয়া দরকার হয়ে পড়েছে। আর সমাজ সংসারে কী ঘটছে সেটা বোঝার জন্য এখনই যদি নারী পড়ালেখা না করে, জ্ঞানের আশ্রয় না নিয়ে শুধু ধর্মকর্মের ভেতর আশ্রয় নেয় তাহলে কিন্তু পুরুষের পায়ের নীচে নারীর বেহেস্ত রচিত হতে আর বেশিদিন বাকি নেই।