১৮৭১ সালে হুগলির ৩৩ জন কুলীন ব্রাহ্মণ বিয়ে করেছিলেন ২১৫১ জন নারীকে। অর্থাৎ গড়ে একজন পুরুষের বিপরীতে ছিলেন ৬৫ জন স্ত্রী! শুধু ভারতবর্ষের দিকে তাকালে হবে না, ইরানের দ্বিতীয় শাহ ফাতেহ আলী কাজার একলাই বিয়ে করেছিলেন ১৫৮ জন নারীকে এবং উনার হেরেমে ছিলেন প্রায় ১০০০ এর উপরে কিশোরী। তবে বহুবিবাহের প্রতিযোগিতায় বাদশা সোলায়মানকে কেউ হারাতে পারবেন না। ইতিহাসবিদদের মতে, উনার বিবাহিত স্ত্রীর সংখ্যা ছিলো ৭০০, এবং হেরেমে ছিলেন আরও ৩০০ জন নারী। চীন, জাপান, কোরিয়া থেকে শুরু করে পৃথিবীর কোন অঞ্চলে পুরুষের বহুগামিতা প্রচলন ছিলো না! উচ্চবংশীয় পুরুষের জন্যে অনেকক্ষেত্রে বহুবিবাহ, বহুগামিতা এবং শিশুকামিতা ছিলো জলভাত বিষয়।
বহুগামিতা পুরুষের ক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ছিলো, এখনও রয়েছে। সামাজিকতার কারণে বর্তমানে পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক হয়তো একজনের সাথেই কিন্তু যৌনতা এখনও অগনিত। যৌনতার জন্যে পুরুষের বাছবিচার নেই। এদের বুড়ি, ছুড়ি, শিশু কখনও বা ছেলেতেও চলে। কিন্তু বিয়ে করার সময়ে দরকার হয় ভার্জিন মেয়ের। উনারা নিজেদের বহুগামী স্বভাবের পরেও স্ত্রীকে দেখতে চান ১০০% সতী হিসেবে। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন ‘বাঙালি পুরুষেরা বিছানায় চান মেরিলিন মনরো কিন্তু স্ত্রী হিসেবে চান সতী-সাবিত্রী।
এক ফেসবুক বন্ধু লিখেছিলেন, এই সতীত্বের পূজা পুরুষের যৌনতার জন্যে নয়, মালিকানার জন্যে। আর বাকীটা নিজেদের যৌন অক্ষমতা ঢেকে রাখার জন্যে।
কাতারের দোহা কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান মার্টিন স্টুয়ার্ট এক গবেষণায় ৫০০ পুরুষের সঙ্গে কথা বলেছেন৷ এদের মধ্যে তিনি ২৭ ধরণের পুরুষের খোঁজ পেয়েছেন৷ সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ বলেছেন, জীবনে কখনও না কখনও তারা স্ত্রী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন৷ ২৭ শতাংশ উত্তরদাতা এ কাজটি করেছেন তাদের বর্তমান সঙ্গিনীর সঙ্গেই৷ আর তাদের সবাই এমন আচরণের পেছনে কোনো না কোনো যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন৷
প্রশ্নটি তখনই ওঠে যখন কোনো নারী হঠাৎই আবিষ্কার করেন যে, তার স্বামী বা প্রেমিক অন্য কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন এবং ক্রমাগত মিথ্যে বলে যাচ্ছেন৷ অবশ্য বিবাহিত জীবনে সততা আশা করা অযৌক্তিক।
স্টুয়ার্ট তার সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন – কেনো তারা সঙ্গিনীর প্রতি সৎ থাকেননি৷ “কেউ কেউ বলেছেন, তার প্রেমিকা শারীরিক প্রেমের বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছিলেন না৷ কেউ আবার বলেছেন, ‘এটা তো শুধুই সেক্স....আমি তো আমার স্ত্রীকেই ভালোবাসি!' কেউ আবার অম্লান বদনে বলেছেন – ‘প্লেটে সাজিয়ে সামনে দিলে খাবো না'?''
যে যেমন অজুহাতই দিন না কেনো, ঠিক কোন কারণটি পুরুষদের প্রতারণার পথে চালিত করছে সেটিই চিহ্নিত করতে চেয়েছেন স্টুয়ার্ট৷
“আমরা আজ যে আচরণ করছি – অনেক ক্ষেত্রে তার শেকড় প্রোথিত সুদূর অতীতে – আমাদের আদি পুরুষের মধ্যে৷ তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় – আদি পুরুষেরা কেনো বহুগামী হতেন? বিবর্তনবাদ অনুযায়ী এর একটি উত্তর হতে পারে প্রজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদ৷” স্টুয়ার্টের মতে, বিবর্তনের ধারায় পুরুষের মস্তিষ্ক এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে, শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অধিকাংশ পুরুষের মধ্যেই কম-বেশি অবিশ্বস্ত হওয়ার প্রবণতা রয়ে গেছে৷ “মোট ২৭ ধরনের পুরুষ আছেন, এদের মধ্যে যে কোনো ধরনের পুরুষের অবিশ্বস্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি৷ সুতরাং সম্পর্কে জড়ানোর আগে নারীদের ভাবতে হবে – কোন ধরনের পুরুষের সঙ্গে তিনি যাচ্ছেন৷”
স্টুয়ার্টের এই ২৭ ধরনের পুরুষের মধ্যে একটি হলো সুযোগসন্ধানী৷ অর্থাৎ, কারো সঙ্গে শরীরী প্রেমের কোনো সুযোগই এরা ছাড়তে চান না৷ পরিণতি কী হবে – সেটাও তারা ভেবে দেখেন না৷ আরেক জাতের পুরুষ আছেন, যারা দুর্বলতার সুযোগ নেন৷ এরা সব সময় পরিস্থিতিকে নিজের পক্ষে নিতে চান এবং নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে পরিবারের সদস্য, বন্ধু, স্ত্রী বা সঙ্গিনীর কাছ থেকে সুবিধা আদায় করেন৷
অবশ্য সব আশা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি৷ স্টুয়ার্ট বলছেন, সমীক্ষায় তিনি বহু পুরুষ দেখেছেন, যারা এখনো সঙ্গিনীর প্রতি সৎ, বিশ্বস্ত, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল এবং মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা রাখেন৷
তাহলে দেখা যায় পুরুষের বহুগামিতার ইতিহাস বহু হাজার বছরের। পুরুষের মজ্জায় ধমনীতে প্রবাহিত বহুগামিতা। পুরুষের বহুগামিতা আজও কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায়ে প্রচলিত থাকলেও নারীর ক্ষেত্রে কোনো কালেই তা স্বীকৃত ছিলো না! পুরুষেরা বহু মহিলাতে আসক্ত হলেও তারা চান তাদের নারী যেন দ্বিতীয় কোনো পুরুষের স্বপ্নও না দেখেন! দেখলেই পাপ!
এই যে পাপ পূণ্যের ধারণা সেটাও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীকে অবদমিত রাখার কৌশল মাত্র! পুরুষতন্ত্র তার সংকীর্ণ স্বার্থজালে নারী ও পুরুষের জন্যে সামাজিক রীতি নীতির পার্থক্যের সুস্পষ্ট বিভাজন তৈরি করে রেখেছে! তার রূপরেখা দেশ কাল সমাজ ধর্মের প্রেক্ষিতে যতোই ভিন্ন হোক না কেনো! আর সেই বিভাজনের হাত ধরেই আজও যৌনকর্মী বলতে সাধারণ ভাবে নারীকেই বোঝায়! পৃথিবীর সকল দেশেই বেশ্যালয় থাকলেও, কোনো দেশেই পুরুষ যৌনকর্মীদের বেশ্যালয় গড়ে ওঠেনি!
প্রকৃতিগতভাবে মানুষ মাত্রই বহুগামী। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর বহুগামীতা স্বীকৃত না। পুরুষদের বহুগামিতা সহ্য করা যায়, নারীর বহুগামিতা সহ্য করা যায় না। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে, নারীরা প্রকৃতিগতভাবে একগামী হন না। কিন্তু নারীকে অবদমিত রাখার জন্যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ধর্মের নামে বিশুদ্ধ উত্তরাধিকারের আশায় নারীকে একগামী হতে বাধ্য করে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলে আসছে যে নারীর যৌন চাহিদা কম বলে তারা একটি পুরুষ নিয়েই সারা জীবন পার করে দিতে পারেন, কিন্তু পুরুষের যৌন চাহিদা অনেক বেশি তাই তাদের একাধিক নারীর প্রয়োজন। কিন্তু ’আবেদনময়ী’ এই শব্দটির জন্মই হয়েছে নারীর জন্যে। যৌনতার আবেদন নারীই বহন করেন।
নারী শুধুমাত্র তার কাঙ্খিত পুরুষের প্রতি ভালোবাসা এবং সমাজের চাপে যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। নারী প্রকৃতিগত ভাবে একগামী - এই পুরো বিষয়টিই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধাপ্পাবাজি।