ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

রাসসুন্দরী দাসী-বাংলা সাহিত্যে প্রথম পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনীকার

বাংলা সাহিত্যের প্রথম পূর্নাঙ্গ আত্মজীবনী কোনো পুরুষ সাহিত্যিকের হাত দিয়ে রচিত হয়নি। রচিত হয়েছে একজন নারীর মাধ্যমে। এই নারী শহরবাসিনী বিখ্যাত কেউ ছিলেন না, ছিলেন না প্রতিষ্ঠিত কোনো সাহিত্যিকও। আটপৌরে এক গ্রাম্য নারী ছিলেন তিনি। পূর্ব বাংলার এক অজ পাড়াগাঁয়ে বিশাল সংসারের ঘানি টেনেছেন তিনি সারাজীবন। কোনো বিদ্যালয়ে তিনি যাননি, কেউ তাঁকে বাড়িতেও বিদ্যাশিক্ষা দেয়নি। নিজ আগ্রহে বহু কষ্টে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজে নিজে পড়া শিখেছেন তিনি। পূর্ণ বয়সে লেখাও শিখেছেন। তারপর ষাট বছর বয়সে অত্যন্ত ঝরঝরে, সহজ সাবলীল এবং সতেজ গদ্যে লিখে ফেলেছেন তাঁর আত্মজীবনী। আর এর মাধ্যমেই তিনি জড়িয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সাথে। কারণ, এটাই বাংলা ভাষার প্রথম আত্মজীবনী। তাঁর এই আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের গ্রাম বাংলার কুসংস্কারসমৃদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা, গৃহে আবদ্ধ বিদ্যাশিক্ষা বঞ্চিত নারীর নিগৃহীত জীবনের সকরুণ বিবরণী। এটা শুধু একজন নারীর জীবনবৃত্তান্তই নয়, হয়ে উঠেছে ইতিহাসের এক প্রামাণ্য দলিলও।

এই নারীর নাম রাসসুন্দরী দেবী। যদিও রাসসুন্দরী দাসী নাম নিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর আত্মজীবনী। সেটার নাম ‘আমার জীবন’। গ্রন্থটির প্রথম অংশ তিনি লিখেছেন ষাট বছর বয়সে, পরবর্তীতে অষ্টাশি বছর বয়সে এর দ্বিতীয় অংশ সংযোজন করেছেন গ্রন্থের সাথে। বইটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৮ সালে। পরবর্তীতে এর সংগে দ্বিতীয় অংশ সংযোজন করে প্রকাশ করা হয় ১৮৯৭ সালে। এই বইটার প্রতিটা অধ্যায় শুরু হয়েছে তাঁর নিজের লেখা কবিতা বা ভক্তি গান দিয়ে।

এই বইটি পড়ে মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। গ্রন্থের ভূমিকায় তাঁর সেই মুগ্ধতার কথা তিনি লিখেছিলেন এভাবেঃ

“এ গ্রন্থখানি একজন রমণীর লেখা। শুধু তাহা নহে, ৮৮ বৎসরের একজন বর্ষীয়সী প্রাচীনা রমণীর লেখা। তাই বিশেষ কৌতুহলী হইয়া আমি এই গ্রন্থপাঠে প্রবৃত্ত হই। মনে করিয়াছিলাম যেখানে কোন ভাল কথা পাইব সেইখানে পেনসিলের দাগ দিব। পড়িতে পড়িতে দেখি, পেনসিলের দাগে গ্রন্থকলেবর ভরিয়া গেল। বস্তুতঃ ইহার জীবনের ঘটনাবলী এমন বিস্ময়জনক এবং ইহার লেখায় এমন একটি অকৃত্রিম সরল মাধুর্য আছে যে, গ্রন্থখানি পড়িতে বসিয়া শেষ না করিয়া থাকা যায় না।”

রাসসুন্দরী তাঁর অকপট জীবন চিত্রের বর্ণনার মধ্য দিয়ে যে সেই সমাজের সমাজের চিত্রকে নিজের অজান্তেই নিপুণভাবে এঁকে গিয়েছেন, সে বিষয়ে দীনেশচন্দ্রও সেনের কোনো দ্বিমত ছিলো না। শুধু সমাজচিত্রই না, এই লেখা না হলে বাংলা সাহিত্যের একটা অধ্যায় অসমাপ্ত থেকে যেতো বলেই তাঁর বিশ্বাস ছিলো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাশাপাশি এই গ্রন্থের আরেকটি ভূমিকা লিখেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন।

রাসসুন্দরীর দেবীর জন্ম ১৮০৯ সালে পাবনার (বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা) পোতাজিয়া গ্রামে। ছোটবেলায় অত্যন্ত ভীরু এবং কোমল স্বভাবের মেয়ে ছিলেন তিনি। তিনি যে সময়ে জন্মেছিলেন, সেই সময়ে নারী শিক্ষা বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিলো না। সমাজ ছিল প্রচণ্ড রকমের কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং ভয়াবহ ধরণের পুরুষতান্ত্রিক। শিক্ষা গ্রহণ করলে মেয়েরা বিধবা হবে, সংসারের অকল্যাণ নেমে আসবে, সতী-সাধ্বী মেয়েরা সব চরিত্রহীন হবে, স্বামীর অবাধ্য হবে, ঘর সংসারের কাজ করবে না, ইত্যাদি নানান ধরনের ধারণাই তখন চালু ছিলো। মেয়েরা বুদ্ধিতে পুরুষদের তুলনায় হীন এবং সে কারণে তারা শিক্ষা লাভের যোগ্য নয়, এই ধারণা পুরষতন্ত্র পুরুষদের মাথার মধ্যে বেশ ভালো ভাবে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছিলো। এই ধারণার বিরুদ্ধ স্রোতে গিয়ে রাজা রামমোহন রায় গর্জে উঠেছিলেন এই বলে যে, “স্ত্রীলোকদিগের বুদ্ধির পরীক্ষা কোন কালে লইয়াছেন যে তাহাদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন? “

রাজা রামমোহনের নারী শিক্ষার প্রতিপোষক এই প্রকাশ্য উক্তির আগেও খৃস্টান মিশনারিরা এ দেশে নারী শিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা করছিলেন। তবে দেশিয় লোকজনের মধ্যে নারী শিক্ষার সমর্থনে এরকম প্রকাশ্য উক্তি রামমোহনের আগে আর কেউ করেনি। এর কিছুদিন পরেই রাজা রাধাকান্ত দেবের পৃষ্ঠপোষকতায় স্কুল অব বুক সোসাইটির ও হেয়ার সাহেবের স্কুলের পণ্ডিত গৌরমোহন বিদ্যালংকার “স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক”একটি গ্রন্থ রচনা করেন। রাজা রাধাকান্ত এই বই মুদ্রণ এবং প্রচার করেন। বাড়িতে এই বই পড়ে কোনো বালিকা যদি পরীক্ষা দিতে চাইতো, তবে স্কুল সোসাইটি বালকদের পরীক্ষা গ্রহণের সময় বালিকাদের নিজ নিজ বাড়িতেই পরীক্ষা দেবার সুযোগ থাকতো। রাজা রাধাকান্ত নারী শিক্ষার পক্ষে ছিলেন, কিন্তু শুরুতেই তিনি নারীদের স্কুলে যাবার বিরোধী ছিলেন। পরে বেথুন সাহেব মেয়েদের স্কুল খুললে, তিনিও নিজের বাড়িতে একটা স্কুল খোলেন।

হেয়ার সাহেবের স্কুল সোসাইটির স্কুলে মেয়েরা পড়তে পারতো। কিন্তু এ বিষয়ে কমিটির মতভেদ হওয়াতে ১৮১৯ সালে Female Juvenile Society নামে একটা নতুন সমিতি গঠন করে সেই সমিতির হাতে বালিকা বিদ্যালয়ের ভার দেওয়া হয়। এ সময় British and Foreign School Society-র উদ্যোগে মিস কুক নামের একজন মহিলা নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য আসেন। ১৮২১ সালে তিনি এদেশে আসেন। ১৮২৪ সালের মধ্যে তাঁর মাধ্যমে ২৪টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়,। কিন্তু এ সব স্কুলে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল খুবই সামান্য।

শহরে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এই প্রাথমিক এবং সীমিত উদ্যোগের কোনো স্পর্শই অবশ্য লাগেনি রাসসুন্দরীদের অজ পাড়াগাঁয়ে। নারী শিক্ষা সেখানে ভিন্ন গ্রহের বিষয় ছিলো। ছেলেদের জন্যও যে খুব একটা ভা্লো ব্যবস্থা ছিলো, তা নয়। তবে, ভালো না হলেও, ছিলো যে, সেটাই বড় কথা।

রাসসুন্দরীদের বাড়িতেই স্কুল বসতো। একজন মেমসাহেব ছাত্রদের পড়াতেন। রামসুন্দরীকে সেই মেম সাহেবের কাছে বসিয়ে রাখা হতো। অন্য বাচ্চারা যখন পড়াশোনা করতো, তার সবকিছুই নীরবে অবলোকন করতেন তিনি। এর ফলে কিছুটা হলে বর্ণপরিচয় তাঁর হয়ে যায়।

বারো বছর বয়সে, বিয়ে কী জিনিস সেটা বোঝার আগেই রাসসুন্দরীর বিয়ে হয়ে যায়। পাত্রের বাড়ি ফরিদপুরের (বর্তমানে রাজবাড়ী জেলা) রামদিয়া গ্রামে। পাবনা থেকে তখন ফরিদপুরে যেতে সময় লাগতো তিন দিন। বিয়ের আনন্দ-অনুষ্ঠান, গান-বাজনা, ধুমধাম, শাড়ি-অলংকার ইত্যাদিতে রাসসুন্দরী নিজেও বিমোহিত হয়ে ছিলেন। তাঁর মাথায় কোনোক্রমেই ঢোকেনি যে, এই সব আয়োজন প্রতিমা বিসর্জনের জন্য। আর এই প্রতিমা অন্য কেউ নয়, তিনি নিজেই। যখন টের পেলেন, তখন মাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কান্নাকাটি করা ছাড়া তাঁর আর কিছুই করার ছিলো না।

বিয়ে যে একজন স্বাধীন বালিকাকে, একজন মুক্ত বিহঙ্গকে, অবারিত আকাশ থেকে টেনে এনে তার পায়ে সোনার শিকল পরিয়ে, নিঠুরভাবে ডানা ভেঙে দিয়ে খাঁচায় বন্দী করে ফেলে, এটা বুঝতে সময় লাগেনি তাঁর। খেলার বয়সে মা, ভাইবোন সব ছেড়ে দিয়ে তাঁকে চলে যেতে হচ্ছে বহু দূরের এক অদেখা দেশে, অচেনা মানুষের খবরদারীতে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের কুৎসিত রূপের দেখা পেয়ে কম্পমান তিনি, ভয়ে মৃতপ্রায়। যে আঁধার রাজ্যে তিনি বন্দী হতে চলেছেন, সেখান থেকে আর কোনোদিনই মুক্তি পাবেন না। সে কারণেই তাঁর মুখ দিয়ে হাহাকার বেরিয়েছে এই বলে, “লোকে আমোদ করিয়া পাখী পিঞ্জরে বন্ধ করিয়া রাখিয়া থাকে, আমার যেন সেই দশা ঘটিয়াছে। আমি ঐ পিঞ্জরে জন্মের মত বন্দী হইলাম, আমার জীবদ্দশাতে আর মুক্তি নাই।“

ওই সময়ে বউদের কঠোরভাবে পর্দা মেনে চলতে হতো। এই পর্দা শুধু পুরুষদের সামনেই প্রযোজ্য ছিলো না, বাড়ির অন্য নারীদের কাছ থেকেও পর্দা করতে হতো। কারো সাথে কথা বলা যেতো না, কারো দিকে তাকানো যেতো না, মোটা কাপড়ের ঘোমটার আড়ালে নির্বাক হয়ে বউদের জীবন কাটাতে হতো।

শুধুমাত্র বাড়ির অন্য লোকজনের সাথেই নয়, আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, নিজের স্বামীর সঙ্গেও পর্দা করে চলতে হতো তখন নারীদের। রাতের বেলা ছাড়া স্বামী স্ত্রীর দেখা সাক্ষাত কদাচিতই ঘটতো। পর্দা প্রথার এই কঠোর অনুশাসন যে শুধুমাত্র গ্রাম্য সমাজে প্রচলিত ছিল তা নয়। শহরের শিক্ষিত সমাজেও এই প্রথা জাঁক বেধেছিল সেই সময়ে। বাঙালি হিন্দু সমাজে পর্দা প্রথাকে তখন দেখা হতো সভ্যতা ও ভব্যতার অংশ হিসাবে। ঠাকুর পরিবার এর জ্বলন্ত উদাহরণ। গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বইতে লিখেছেন “রবীন্দ্রনাথের মা গঙ্গাস্নান করতে চাইলে তাঁকে পাল্কিতে করে গঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু পালকি থেকে তিনি কখনো বের হতেন না। পাল্কি বেহারারা তাঁকে পুরো পাল্কিসুদ্ধ গঙ্গার পানিতে চুবিয়ে তুলতেন।”

এরকম এক বৈরী সামাজিক কাঠামোতে শিক্ষার কথা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে এই গ্রাম্য বধুটির মনের কোণে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ জন্মে উঠে। পুঁথি পড়ার জন্য তাঁর প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠে। কিন্তু একথা প্রকাশ করার মতো সাহসও তাঁর ছিলো না। ফলে একমাত্র উপায় ছিল পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা।

পুঁথি পাঠের এই বাসনা প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে রাসসুন্দরী দেবীর। শুধু পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেই ক্ষান্ত থাকেন না তিনি। এর জন্য প্রাণপাত করতেও দ্বিধা করেন না। তাঁকে পড়া শেখানোর কেউ ছিলো না। শুধু যে কেউ ছিলো না তা নয়, তিনি যে পড়া শিখতে চান, এটা মুখ ফুটে বলার মতো সাহসও তাঁর ছিলো না। বিদ্যা শিক্ষা নারীদের জন্য তখন ঘোরতর নিন্দনীয় কাজ। তিনি মনের মধ্যে ইচ্ছা এনেছেন শুধু এটুকু জানলেই আকাশ ভেঙ্গে পড়বে অনেকের মাথার উপরে। এই পরিস্থিতিতে এখানেই ইতি হয়ে যাবার কথা ছিলো সবকিছুর। এমন স্বপ্ন হয়তো আরো অনেক নারীর মধ্যেই জেগেছে তখন, কিন্তু সেই স্বপ্নের বীজ চারা হয়ে মাটি ভেদ করে আলোর মুখ দেখে নি বৈরী এবং বন্ধা পরিবেশের কারণে। কিন্তু রাসসুন্দরী থেমে থাকেননি। কারো সাহায্যের অপেক্ষায়ও বসে থাকেননি। এই গ্রাম্য নারীটি অদ্ভুত এক উপায়ে নিজেকে নিজে পড়ালেখা শেখা্নোর দায়িত্ব নেন।

অদ্ভুত, আয়েসবিবর্জিত এবং সময়সাপেক্ষ এক পন্থা ছিলো সেটি। সেই সময়ে তিনি বেশ কয়েক সন্তানের জননী হয়ে গেছেন, বিরাট এক সংসারের বউ তিনি। তিন ননদই ততদিনে বিধবা হয়ে ফিরে এসেছে বাপের বাড়িতে। তাঁর ঘাড়েই সংসার সামাল দেবার সমস্ত বোঝা। তারপরেও এই সব হাজারো ঝামেলা সামলে এই অসাধারণ মহিলাটি কীভাবে পড়া শিখলেন তা তাঁর নিজের মুখ থেকেই শোনা যাক।

“তখন আমার বড় ছেলেটি তালপাতাতে লিখিত। আমি তাহার একটি তালের পাতাও লুকাইয়া রাখিলাম। ওই তাল পাতাটি একবার দেখি, আবার ঐ পুস্তকের পাতটিও দেখি, আর আমার মনের অক্ষরের সঙ্গে যোগ করিয়া দেখি, আবার সকল লোকের কথার সঙ্গে যোগ করিয়া মিলাইয়া মিলাইয়া দেখি।

আমি যে ছেলেবেলায় স্কুলে বসিয়া থাকিতাম, তাহাতে আমার অনেক উপকার হইয়াছে। আমি সেই পুস্তকের পাতটি ঐ তালের পাতটি লইয়া মনের অক্ষরের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিতাম। আমি এই প্রকার করিয়া সকল দিবস মনে মনে পড়িতাম। আমি অনেক দিবসে, অনেক পরিশ্রমে, অনেক যত্নে এবং অনেক কষ্ট করিয়া ঐ চৈতন্যভাগবত পুস্তকখানি গোঙ্গাইয়া পড়িতে শিখিলাম।“

রাসসুন্দরী দেবী গোঙ্গাইয়া পড়তে শিখলেন ঠিকই, কিন্তু সমাজের চোখ রাঙানিতো আর বন্ধ হয়নি তাতে। পুস্তক পড়া শিখেছেন, কিন্তু সংসার সামলাতে গিয়ে তা পড়ার সময় নেই। সময় যেটুকু পান, সেখানেও নিরন্তর এক ভয়ের রাজ্যের বসবাস তাঁর। কেউ দেখে ফেললেই যে সর্বনাশ! এ আবার কি? মেয়েছেলে লেখাপড়া করছে? মেয়েছেলে লেখাপড়া করা বড় দোষ। মেয়েছেলে লেখাপড়া শিখলে সর্বনাশ হয়, মেয়েছেলে কাগজ কলম হাতে করতে নাই।

পড়াটা শিখলেও লেখা শেখাটা তখনও হয়ে উঠেনি তাঁর। পড়াটা যতোখানি গোপনে করা যায়, সে সময়ে লেখাটা অতোখানি গোপনে করা সম্ভবপর ছিলো না। নানান ধরণের আয়োজন করে তখন লিখতে হতো। এগুলো করার মত সঙ্গতি তাঁর ছিলো না। অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসার জন্য তিনি তাঁর পঞ্চম পুত্র দ্বারকানাথের বাড়ি কাঁঠালপোতায় ছয় মাসের মত ছিলেন। সেখানেই ছেলের সহযোগিতায় লেখাটাও শিখে ফেলেন তিনি।

বারো বছর বয়সে বালিকা বধু হয়ে স্বামীর সংসারে এসেছিলেন তিনি। আঠারো বছর বয়সে প্রথম সন্তানের জন্ম দেন। একচল্লিশ বছর বয়স শেষ সন্তানের। মাত্র তেইশ বছরের মধ্যে বারোটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি। একজন নারীর জীবন এখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই ভয়াবহ নির্যাতনের পরে একজন নারীর জীবনীশক্তি বলতে আর কিছু থাকার কথা নয়। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর সেটা ছিলো।

অনেক ভালো কিছুই বলা হলো তাঁর বই সম্পর্কে। খারাপ কিছু কি নেই? হ্যাঁ, আছে। তিনি যে নিগুঢ় কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছেন, সম্পূর্নো নিজের চেষ্টায়, নিজস্ব গভীর মনোবলের প্রভাবে, এটাকে বার বার তিনি পরমেশ্বরের উপহার বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া তাঁর বইতে তিনি কিছু অলৌকিক ঘটনার কথা বলেছেন। তাঁর সন্তানদের কিছু কিছু ঘটনা, যেগুলো তাঁর চোখের সামনে ঘটে নি, কিন্তু তিনি আগেই তা দেখতে পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। এবং তাঁর দেখা ঘটনার হুবহু অনুরূপই বাস্তবে ঘটেছে বলে বলেছেন। এমনকি তিনি তাঁর নিজের মৃত্যুদৃশ্যও আগেভাগেই অলৌকিক উপায়ে দেখে ফেলেছেন, এবং মৃত্যুতে যে কিছুমাত্র ভয় নাই, এটা তিনি বিলক্ষণরূপে প্রত্যক্ষ করেছেন বলে জানিয়েছেন।

রাসসুন্দরী যে প্রাচীন সময়ে জন্মেছেন, যে কুসংস্কারাচ্ছন ধর্মীয় সমাজে বড় হয়ে উঠেছেন, সেই পরিবেশের প্রভাব তাঁর উপরে পড়েছে। তাঁর নিরন্তর পড়ালেখার প্রতি আগ্রহের পরেও, সেই সমাজচিন্তাকে পুরোপুরি নিজের ভিতর থেকে বের করতে পারেননি তিনি। পারা সম্ভবও ছিলো না আসলে। অন্য সকলের মত তিনিও প্রবলভাবে ধার্মিক ছিলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কুসংস্কারাচ্ছন্নও ছিলেন। এই ধার্মিকতার কারণেই আসলে তাঁর পড়ার সূত্রপাত। এই প্রেক্ষাপটে বিচার করলে, তাঁর অলৌকিক দর্শনকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখা যেতে পারেই।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বাংলাদেশে নারীদের অবস্থা কী রকম ছিলো, তাঁর প্রামান্য দলিল রাসসুন্দরীর আমার জীবন। অকপটে সহজ সরল ভাষায় তিনি বর্ণনা করেছেন নিজের কথা। সেই নিজের কথাই আজ হয়ে উঠেছে সেই সময়কার সমাজে নারীর অবস্থানের সমাজচিত্র। এ লেখা যে শুধুমাত্র আজকের নারীদের শিক্ষার বিষয়ে অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দেবে, তাই নয় বরং ঊনবিংশ শতাব্দীর নারীর সামাজিক অবস্থানের চিত্র অংকনে সমাজতাত্ত্বিকদেরও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। এর থেকে নির্ভরযোগ্য দলিল আর কী হতে পারে?

4659 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।