ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

মারিনা নেমাত: প্রিজনার অব তেহরান

ছবিতে যে ফুটফুটে কিশোরী মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে, তার নাম মারিনা নেমাত। বয়স মাত্র চৌদ্দ বছর। ছবিটা ১৯৭৮ সালে তোলা। যদি বলি ছবিটা ইরানের মাটিতে তোলা, তাহলে অনেকেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে এখন। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও, এটাই সত্যি। ছবিটা ইরানে তোলা। এক সময় ইরানের মেয়েরা এমনই আধুনিক পোশাক পরতো। মারিনার মতো পোশাক পরার, রাস্তায় সাইকেল চালানোর সাহসতো দূরের কথা, স্বপ্ন দেখার কল্পনাও এখন আর ইরানের মেয়েরা করে না। এই রকম পোশাক পরে বাইরে বের হলে এখন মৃত্যু নিশ্চিত। অতল এক অন্ধকারে পতিত হয়েছে তারা।

এই ছবি তোলার এক বছর পরেই আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে বিপ্লবীরা রেজা শাহ পাহলবীকে ক্ষমতাচ্যুত করে দখল করে নেয় ইরানের রাষ্ট্র ক্ষমতা। মোল্লাতন্ত্রের দাপটে আধুনিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ ইরান অতি দ্রুত পরিণত হয় ধর্মীয় গোঁড়ামিযুক্ত এক মৌলবাদী দেশে।

১৯৮২ সালে মারিনার বয়স যখন মাত্র ষোলো, ক্লাস টেনে পড়া এক স্কুল ছাত্রী, তখন তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। এই কাজটা করে ইরানিয়ান রিভোলুশনারি গার্ডের লোকেরা। তার বিরুদ্ধে সরকার এবং রাষ্ট্রবিরোধী অভিযোগ আনা হয়। তার অনুপস্থিতিতেই তার বিচার হয়, বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

তাকে গুলি করে মারার সময়ে বিপ্লবী গার্ডের এক সৈনিক প্রাণে বাঁচায়। তার নাম আলী। আলীর পরিবার খোমেনীর পরিবারের সাথে সম্পর্কিত ছিলো। আলী মারিনার দণ্ড মওকুফের সুপারিশ করে। খোমেনী দয়া করে মৃত্যুদণ্ড থেকে তার সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে নামিয়ে আনে।

আলী এই কাজটা মহৎ কাজ হিসাবে করে না, করে না কোনো ভালবাসা বা প্রেম থেকে। মারিনাকে সে ভয় দেখিয়ে বাধ্য করে তাকে বিয়ে করতে। ১৯৮২ সালে মারিনা বাধ্য হয় আলীকে বিয়ে করতে। এর আগে আলীর পরিবার আরেকটি কাজ করে। মারিনা ধর্মে খৃস্টান। তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার নির্দেশ দেয় তারা বিয়ের পূর্বশর্ত হিসাবে। মারিনার কোনো উপায় ছিলো না। সে মুসলমান হয়, ফাতেমা নাম গ্রহণ করে।

বিয়ের রাতেই স্বামীত্ব ফলাতে মারিনার প্রবল বাধাকে উপেক্ষা করে তাকে ধর্ষণ করে আলী। এই ধর্ষণ এক রাতেই শেষ হয় না। চলতে থাকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত।

একদিন আলীও খুন হয়ে যায় অদৃশ্য আততায়ীদের হাতে। বিস্ময়করভাবে এই সময় দৃশ্যপটে আসে আলীর পরিবার। তারা মারিনার মুক্তির ব্যবস্থা করে। মুক্ত হয়ে কৈশোরের ভালো লাগা এবং ভালবাসার মানুষ আন্ড্রেকে বিয়ে করে মারিনা। ১৯৯০ সালে ইউরোপের এক ক্যাথলিক গ্রুপের ভরসায় ইউরোপে পাড়ি জমায় তারা। সেখান থেকে কাগজপত্র জোগাড় করে ১৯৯১ সালে ক্যানাডায় শরণার্থী হিসাবে চলে আসে মারিনা।

ইরানের সেই দুঃসময়ের স্মৃতিচারণ মারিনা করেছে তার প্রিজনার অব তেহরান বইতে।

মারিনার এই ছবিটা এবং তাঁঁর লেখা প্রিজনার অব তেহরান বইটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই বইটা পড়লেই আমি বুঝি বাংলাদেশ কোন পথে এগোচ্ছে। মারিনার এই ছবি দেখে অনুভব করি একটা সমাজ হঠাৎ করে কোন দিকে বাঁক নিতে পারে। বাংলাদেশের মেয়েদের পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই কিংবা দুই হাজার সালের পরের ছবি দেখলেও আমি বাংলাদেশ দেখার অনুভব পাই। এখনকার মেয়েদের ছবি দেখলে অচেনা এক বাংলাদেশ মনে হয়। মনে হয় এই বাংলাদেশকে চিনি না আমি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটলে এমনটা ঘটে। সবকিছুকেই অচেনা লাগে, পর পর মনে হয়। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই অচেনা লাগার পরিমাণটা আগামীতে কমার পরিবর্তে আরো বাড়বে।

আমরা কি বুঝতে পারছি, অচেনা এক পথে দ্রুত ধাবমান হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ।

2152 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।