মানবসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের দিকটি একটি বায়োলজিক্যাল প্রক্রিয়ার চিহ্নায়ক। এক্ষেত্রে নারীর জীববৈজ্ঞানিক সত্তায় সন্তান ধারণের বিষয়টি মানব পৃথিবীতে একটি বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতারই নামান্তর, যেহেতু এখানে নারীই সন্তান ধারণ করার ক্ষমতা রাখে পুরুষ বা অন্য কোনো মানব প্রজাতি নয়। যদিও সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মিলনের মাধ্যমটিই সম্মিলিত প্রয়াস হিসেবে এখনও পর্যন্ত জনপ্রিয় বায়োলজিক্যাল প্রক্রিয়া, তবে আজকাল সারোগেসি পদ্ধতির মতন সন্তান জন্মদানের অপ্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার উদ্ভাবনের পর পুরুষের সাথে নারীর মিলনের বিষয়টি এক অর্থে ব্রাত্য হয়ে উঠেছে। এটি সন্তান জন্মের প্রক্রিয়ায় পুরুষের অপরিহার্যতাকে যেনো খানিকটা অপ্রয়োজনীয় বলেই নির্দেশ করছে। কিন্তু আসলেই কি তাই?
প্রক্রিয়াগতভাবে তা মনে হলেও, প্রাকৃতিক বিষয়টিকে আমরা যতই প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন করতে চাই না কেনো তাতে মানুষের জন্য এর প্রভাবে এক কৃত্রিম পৃথিবী গড়তেই মূলত সাহায্য করি। এটি কতটা উপকারী তা সময় বলবে, কিন্তু গর্ভধারণের ক্ষেত্রে নারীর অপরিহার্যতার বিষয়টি কিন্তু এখনও স্বমহিমায় উজ্জ্বল, এই বার্তাটি বরাবরের মতনই স্পষ্ট। তবে প্রাকৃতিক উপায়ে নারীর গর্ভধারণের এই অপরিহার্যতাকে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষতান্ত্রিক নারী-পুরুষেরা যেভাবে দ্বিচারিতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করে তা বর্তমানে কুসংস্কারের পর্যায়ে পড়ে। এই বিষয়টিই যেনো আলোচিত-সমালোচিত নায়িকা পরী মনি তাঁর উন্মুক্ত "বেবি বাম্প"-এর ছবি প্রকাশ করে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সামনে এক তীব্র কটাক্ষ হিসেবে ছুঁড়ে দিয়েছেন। আর মুহুর্তেই জনগণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে তাঁর এই প্রকাশিত স্থিরচিত্রটি। আলোচনা-সমালোচনায় মুখর হয়ে দ্বিধাবিভক্ত এখন বাংলার জনসাধারণ। এই যখন অবস্থা আমি এই স্থিরচিত্রটি থেকে প্রাপ্ত বিষয়াদি নিয়ে লিখতে চাই। কারণ এই ছবিটি প্রকাশের পর লোকেরা জাত গেলো গেলো রব তুলে দিয়েছে, অশ্লীলতা আর অরুচির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তাদের অনেকের বক্তব্যে। আদতেই কী ছবিটিতে কোনো অশ্লীলতা ও অরুচিকর কিছু রয়েছে? নাকি অনেক কিছুই দৃশ্যপট থেকে বাদ রয়ে গেছে? চলুন একটু বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
কী কী অনুপস্থিত পরী মনির বেবি বাম্পের স্থিরচিত্রে?
পরী মনি বর্তমানে এ দেশের আলোচিত-সমালোচিত একজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। নায়ক-অভিনেতা শরীফুল রাজ ও তাঁর যৌথ প্রয়াসে এই মুহুর্তে তাঁরা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁরা এবারের ইদে কক্সবাজারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি ফটোশ্যুটে অংশগ্রহণ করেন। পরীমণির 'বেবিবাম্প'-এর স্থিরচিত্রে তিনি তাঁর পুরুষসঙ্গী স্বামী রাজের সাথে শৈল্পিক উপস্থাপনে ধরা দিয়েছেন। বস্তুত এই শৈল্পিক উপস্থাপন সবার মননে শিল্পিত উপস্থাপন হিসেবে ধরা দেয়নি। কিন্তু আমার কাছে এর ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। আমার দৃষ্টিতে এতে কী কী শিল্পিত উপায়ে ধরা দিয়েছে এবং দেয়নি তার বয়ান এখানে তুলে ধরতে চাই। প্রথমেই অনুপস্থিত বিষয়গুলো নিয়ে বলি-
১. এই ছবি দেখে আমি মনে করছি সমালোচনা যা যা থাকতে পারে, তা হলো এই ছবিতে গর্ভবতী মায়েদের শরীরে যে 'স্ট্রেচ মার্ক' পড়ে, তা ধরা পড়েনি, মেকআপের কল্যাণে তা ঢাকা পড়ে গেছে। তবে সৌন্দর্যের দেবীর এইটুকুন আড়ালকে ঋণাত্মকভাবে নাইবা দেখা যাক।
২. এখানে আরও যা যা দেখা যাচ্ছে না তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরের হাড়ের সংযোগস্থল ঢিলে হয়ে যাওয়ার দরুণ, তার হাড়ের সংযোগস্থলে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। এছাড়াও পেট ভারি হওয়ার কারণে বা শরীরের সামনের অংশ বেড়ে যাওয়ার কারণে, গর্ভবতী নারীদের পিঠের হাড়ে চাপ তৈরি হয় এবং তাতে তাদের প্রচণ্ড পিঠে ব্যথা হয়ে থাকে। এমনকি গর্ভাবস্থায় তাদের দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়ার কারণে, দাঁত মাজার সময় রক্ত বের হওয়া এবং তাদের মাড়িতে অসহ্য ব্যথা হয়। এদিকে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য এ সময়ে নারীর জরায়ুর আকার বড় হয়ে যায়, ফলে তাদের মূত্রথলিতে চাপ পড়ে এবং এই রকমের শারীরিক অবস্থাতে তাদের বারবার প্রস্রাব করতে যেতে হয়। যা অসম্ভব রকমের কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। এছাড়াও জরায়ুর আকার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ফুসফুস পর্যাপ্ত প্রসারিত হতে পারে না। এতে করে অনেক নারীর এ সময়ে শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে। গর্ভাবস্থায় নারীর শরীরে আয়রনের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে রক্তশূন্যতা হওয়ার আশঙ্কা থাকে, অনেকের আবার উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে এবং এই অবস্থায় শরীরে তরল উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায়, অনেক গর্ভবতী নারীর পায়ে পানি জমে ফোলা ভাব হয়ে থাকে। হরমোনের কারণে এ সময়ে নারীদের স্তনের আকারে বড় হতে থাকে, স্তনবৃন্তের আশপাশ কালো হয়ে ওঠে। কারণ শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর জন্য এই সময়টাতেই নারীর স্তন প্রস্তুত হতে থাকে। প্রাকৃতিক এই বিষয়টিতে অনেক গর্ভবতী নারীর বেলাতেই, তারা স্তনে ব্যথা অনুভব করেন।
প্রসবের পর অনেক কিছুই তার আগের জায়গায় ফিরে যায় না। অনেকের ওজন, স্ট্রেচ মার্ক, ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়ে যায়। শারীরিক এই ব্যাথা-বেদনাগুলোর কোনোটিই এই ছবিতে মূর্তায়িত হয়নি। এসব এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে না, দেখতে পারার কথাও নয়। তবে এই বিষয়গুলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উপলব্ধিতে আনানোর প্রয়োজন রয়েছে। আশা করি এই যন্ত্রণাদায়ক অবস্থাগুলো তাদের উপলব্ধিতে এলে, নারীকে তারা কেবল 'মা' চরিত্রে মূর্তায়িত করার জন্য উঠে পড়ে লাগা থেকে বিরত হবে। উক্ত বিষয়গুলো কোনোদিন উপস্থাপিত করানো গেলে, সেসবের মাধ্যমে নারীকে মাতৃত্বের গৌরবে গৌরবান্বিত অনুভূত করানোর মতন পুরুষতান্ত্রিক অপকৌশল থেকে মুক্ত করানো; বিশেষত এই অসাধু এজেণ্ডাগুলো বাস্তবায়নে যেসব পুরুষতান্ত্রিক নারী-পুরুষেরা মুখিয়ে থাকেন তাদের উৎসাহে ভাটা আনানো সম্ভব হবে বলে আশা করা যেতে পারে।
৩. এই ছবিটাতে কেবল শারীরিক নয়, নারীর গর্ভকালীন মানসিক অবস্থার দুর্বিষহ বহু বিষয়গুলোই দেখা যাচ্ছে না। কারণ উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরিবর্তন, গর্ভাকালীন একজন নারীর মনের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে থাকে। এই ছবিতে সেই মানসিক চাপের বিষয়টি অনুপস্থিত। কারণ উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরিবর্তন, গর্ভাকালীন একজন নারীর মনের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে থাকে। এই ছবিতে সেই মানসিক চাপের বিষয়টি অনুপস্থিত। কারণ এসময় নারীর মনের মাঝে বহুমুখী উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা, মন খারাপ, রাগ, ঘন ঘন মেজাজ বদল এরকম অনেক কিছু ঘটে থাকে। যা এখানে প্রদর্শিত হয়নি। অনেকের বেলাতে তো এমন হয় যে, আবেগের উপর তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার দরুণ খুব অল্পতেই কেঁদে ফেলেন, বিরক্ত হন, রেগে যান, মেজাজ তাদের ভীষণ খিটখিটে হয়ে যায়। গর্ভবতী নারীর আবেগে এ সময়ে বড় ধরনের পরিবর্তন হয় কারণ এ সময়ে কিছুই আর তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কোনোদিন শরীর ভাল থাকে, তো আবার দেখা গেলো এর পরের দিনই তার শরীর খারাপ লাগছে। শরীরের অবস্থার এই ওঠানামা গর্ভবতী মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর তীব্রভাবে প্রভাব ফেলে। মন চাইলেই তারা পূর্বের ন্যায় অনেক কিছু করতে পারেন না, ফলে তাদের মনের মধ্যে এক ধরনের বন্দিত্বের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। পরীমণির বেবিবাম্প প্রকাশিত এই ছবিটাতে সন্তানসম্ভবা নারীর এই মানসিক জটিলতাগুলোর উপস্থিতি একেবারেই নেই।
৪. উল্লেখ্য একজন গর্ভবতী নারীমূর্তি এমনি এমনিই গড়ে ওঠে না। এর আগে-পিছে আরও অনেক যন্ত্রণার ইতিহাস বিদ্যমান। নারীকে গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত রাখতে, প্রকৃতি প্রতি মাসের নির্দিষ্ট সময়ে তার জন্য রজঃচক্র কাল নির্ধারণ করে রেখেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে ঋতুচক্রকালীন ব্যথা কখনো কখনো হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যাথার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি হয়ে থাকতে পারে। সুতরাং নারীর প্রসববেদনা তো এর চেয়ে আরও অনেক গুণ বেশি হয়ে থাকবেই। বিজ্ঞান বলে এটি কয়েকটা হার্ট এটাকের ব্যথার চেয়েও অনেক বেশি হয়ে থাকে।
মোটকথা নারী গর্ভবতী হওয়া ও সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার মানে হলো সে তার নিজের জীবনের ঝুঁকি নেয়। এই যে একটা জীবনযুদ্ধে সে নামে, তার ছাপ এই ছবিতে নেই। আছে একটি প্রাণ জন্ম দেওয়ানোর মতন ভয়-ভীতিহীন অসম্ভব শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ।
এবার আসি উল্লেখিত স্থিরচিত্রে আমার দৃষ্টিতে কী কী পরিলক্ষিত হয়েছে-
১. এখানে আমি দেখছি একজন সন্তানসম্ভবা মাকে, কোনো সুন্দরী নায়িকাকে নয়। উক্ত মা, যিনি কিনা আবার শারীরিক সৌন্দর্যের দিক থেকে এদেশীয় বর্তমান চলচ্চিত্র জগতের অতুলনীয় একজন অবতার। তাঁর নিখুঁত শরীর অনেকের স্বপ্ন-সাধনার বিষয়, কিন্তু সেই শরীরেরই বেঢপ আকৃতিকে তিনি কী অবলীলায় প্রকাশ করেছেন এই স্থিরচিত্রটির মাধ্যমে। কারণ তিনি এই মুহুর্তে সন্তানসম্ভবা একজন নারী, কেবল পুরুষের তথাকথিত স্বপ্নের নায়িকাই নন তিনি।
২. এখানে আরও দেখা যাচ্ছে মা হওয়ার প্রারম্ভিক প্রতিটি পর্যায়কে পরী মনি উপভোগ করছেন। এমনকি তাঁর পুরুষ সঙ্গী রাজ এখানে তাঁকে মানসিক সমর্থন দিয়ে সার্বক্ষণিক পাশে রয়েছেন, এটাও এখানে বিশেষভাবে দৃশ্যমান। কারণ পরম মমতায় পরীবর পরীমণিকে আগলে আগলে রাখছেন, খুশি রাখছেন তার একান্ত সঙ্গিনীকে। দু'য়ের এই ভালোবাসাবাসির উদযাপনগুলো এতটাই স্বর্গীয়, যা চোখের সামনে দেখতে সত্যিকার অর্থেই ভালো লাগার মতন।
৩. বেবি বাম্প বা সন্তানবতী মায়ের ফোলা পেট দেখছি এখানে, যেমনটা অন্যরাও দেখছেন। আমাদের মায়েরা-বোনেরাতো সবসময় তাদের এ সময়কার শারীরিক ও মানসিক কষ্টগুলো ঢেকেঢুকে রাখে। কারণ সমাজ তাঁদের শিখিয়েছে এই সময়কালের সবকিছু ঢেকেঢুকে রাখার মাঝেই নারীর সম্মান লুকায়িত। অথচ মাতৃত্ব নাকি নারীর গৌরব, নারীত্বের অহংকার(!)
তবে তা ঢেকে রাখার মাঝে সম্মান লুকায়িত কেনো? হাস্যকর না? যে পেট ফুঁড়ে বের হলাম, সেই বেঢপ পেট দেখতে এত অনিচ্ছা কেনো আমাদের? নাকি ডানাকাটা পরীর মেদহীন পেট দেখে উত্তেজিত হওয়াটা সুন্দর, কিন্তু সেই উত্তেজনায় পেটে বাচ্চা এলে এবং পেটের মাঝে বাচ্চা বেড়ে ওঠায় ফুলে ওঠা পেট দেখাটা অসুন্দর? বিষয়টা কেমন দ্বিচারিতা হয়ে যায়, কী বলেন? আমি দ্বিচারী নই। তাই এখানে আমি সমাজের কাছে অশ্লীল বা অরুচিকর বনে যাওয়া প্রকাশিত ছবিতে, একজন গর্ভবতী মায়ের সন্তান পেটের উদযাপনটা দেখছি। দেখছি কষ্টকে জয় করা এক নারীর শক্তিমত্তার প্রদর্শনকে এখানে মূর্ত হতে। কারণ আমার কাছে মেদহীন পেটের উত্তেজনা সৃষ্টিকারী নারীমূর্তি পরী মনি যেমন সুন্দর, সন্তান পেটে বেবিবাম্প প্রদর্শন করা বেঢপ শরীরের নারীমূর্তি হিসেবেও পরী সমান সৌন্দর্যের দেবী। উভয় প্রকাশেই রয়েছে শৈল্পিক ছোঁয়া।
৪. এই ছবিতে লক্ষণীয় যা কিছু আছে, তার মাঝে তরঙ্গায়িত সমুদ্রের সাথে সন্তানসম্ভবা নারীর ক্ষণে ক্ষণে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আর ব্যথা-বেদনার তরঙ্গকে একীভূত হতে দেখছি। বিক্ষুব্ধ সমুদ্র যেনো নারীজীবনের ঝড়-ঝঞ্ঝাময় উত্থান-পতন আর অস্থিরতাকেই এখানে মঞ্চায়িত করছে। কতশত বাধাবিপত্তি পেরোনো পরী মনির উদ্ধত মাথাটা হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে প্রকৃতির মতনই উদ্ভাসিত হয়ে আছে এই ছবিটাতে। প্রকৃতি ও নারীর এই যন্ত্রণাকাতরতা সত্ত্বেও দৃঢ়চিত্ত রূপটি এখানে আমার চোখে অপূর্ব সুন্দরের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরা দিচ্ছে।
৫. মোটকথা এই ছবিতে দেখছি প্রকৃতি ও নারী কী অঙ্গাঅঙ্গিভাবে মিশে আছে, প্রেম কী অদ্ভুতভাবে এখানে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে। খোলা আকাশ আর সুবিশাল সমুদ্রতট যেনো নারীর উন্মুক্ত উদযাপনকে স্বাগত জানাচ্ছে। কারণ নারীই প্রকৃতি, নারীর সাথেই প্রকৃতি এখনও সংযোগ রক্ষা করে চলে। নারীর রজঃচক্র ও সন্তান জন্মদানের পর্যায়গুলো প্রকৃতির সাথে নারীকে অনেক বেশি অকৃত্রিম বন্ধনে যুক্ত রেখেছে। এক অর্থে বলা যেতেই পারে এই কৃত্রিম পৃথিবীতে পুরুষতো প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন এক হতভাগ্যপ্রাণ, কারণ প্রকৃতির সাথে তার সরাসরি কোনো সংযোগ নাই। তাকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসতে হলে, নারীর কাছে আসতে হবে। এটা পুরুষতান্ত্রিক নারী-পুরুষের বোঝা জরুরি। এই অনিন্দ্যসুন্দর ছবিটাতে আমি প্রকৃতির সাথে পুরুষের একাত্ম হতে চাওয়ার সুতীব্র আন্তরিক বাসনা দেখতে পাচ্ছি, যেমনটাই আদতে হওয়া উচিৎ। পরীপতি রাজকে একজন মানবিক সত্তা হিসেবে তাই আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই।
৬. সর্বোপরি এই ছবিটাতে একজন গর্ভবতী নারীর প্রতি সমাজের প্রচলিত চর্চার ঋণাত্মক দিকটিকে, আমলে না নেওয়ার প্রয়াসটি উপস্থাপিত হয়েছে। গর্ভবতী নারী হিসেবে অনেক যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা লুকিয়ে দৃঢ়চেতা একজন হিসেবে পরী মনি এখানে ধরা দিয়েছেন। একজন সত্যিকারের শিল্পীর দায়িত্ব পালন করতে এখানে তাঁকে আমি দেখছি। শিল্পী তারাই যারা সমাজের প্রাচীনপন্থী কুসংস্কারগুলোকে দুমড়ে-মুচড়ে নতুন সৃষ্টির পথে এগিয়ে যায় এবং সমাজকেও তাদের সাথে এগিয়ে নেওয়ার ব্রত নেয়।
নারীজীবনের জন্য মাতৃত্বের এই পর্যায়টি একটি স্বাভাবিক বায়োলজিক্যাল প্রক্রিয়া, তাই এটিকে অনর্থক অতি গৌরবান্বিত না করে স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যে উদযাপন করার মাধ্যমে পরী এখানে গর্ভবতী নারীদেরকে সমাজে 'অসুস্থ' আখ্যায় ও ব্যাখ্যায় চিহ্নায়নের পথটিকে রুদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কারণ এই সমাজ নারীর মাতৃত্বকে গৌরবের বলে, আবার তারাই নারীর গর্ভবতী শরীরকে অচ্ছুৎ এবং গর্ভধারণের জন্য প্রয়োজনীয় রজঃচক্রকালকে অশুচি বলে। এটি স্পষ্ট দ্বিচারিতা। তারা নারীর কাছে সন্তান প্রত্যাশা করে, নারীকে গর্ভধারণের যন্ত্র বলে ভাবতে পছন্দ করে; কিন্তু নারীর গর্ভধারণকালকে তারা অসুস্থতা হিসেবে দেখিয়ে নারীকে অক্ষম বলে প্রচার করে। এমনকি সন্তান ধারণের সময়কালের যাবতীয় ব্যথা-বেদনা-মানসিক চাপ এবং জন্মের পর সন্তানকে লালন-পালন করার দায়িত্বটিকে একান্তভাবেই নারীর উপর চাপিয়ে দেওয়ার কূটকৌশলে, মাতৃত্বকে তারা অতিমাত্রায় গৌরবের বলে অপপ্রচার করে নারীদের মনকে বিভ্রান্ত করে। সন্তান জন্মদানে অংশগ্রহণ অবশ্যই একটি বিশেষ বিষয় মানবজীবনের জন্য, কিন্তু জীবনের অপরাপর ভূমিকাগুলোও অতি তুচ্ছ নয় এর কাছে। পরীমণি যেমন মা, তেমনি একজন শিল্পীও। সন্তানের মা হওয়ার পাশাপাশি বিনোদন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তার গুরুত্ব সমাজের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই বৈচিত্র্যগুলোই নারীর সৌন্দর্য। বৈচিত্র্যের পথ রুদ্ধ করে নারীকে একটি ভূমিকায় আবদ্ধ করাটা পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের অংশ। তাই নারীর গর্ভধারণের পথে অন্যান্য ব্যক্তিদেরকে তাদের করণীয় সম্পর্কে, দায়িত্ব ভাগ করার বিষয়ে সচেতন করতে ভূমিকা রাখাটা জরুরি। পরীমণি স্বামী রাজকে সঙ্গে নিয়ে এই গর্ভযাত্রার ছবি প্রকাশ করে আমি মনে করি এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, এই যাত্রাটি তাঁর একার নয়। এই যাত্রাপথে আরও অনেকের দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে এবং সেটি করলে তবেই তা হবে সুস্থ ও সুন্দর চর্চার উত্তম উদাহরণ। এই ছবিতে বিশেষ করে যে বিষয়টি পরী মনি তুলে ধরেছেন বলে আমি মনে করি তা হলো, তাঁর এই গর্ভকালীন সময়টা যে রেখেঢেকে রাখার বিষয় নয়, নয় একান্তই তাঁর নিজের কিছু তা সমাজের বোঝা উচিৎ। কারণ একটি শিশু এই সমাজের, এই রাষ্ট্রের। একটি পরিবারের কেবল নয়, কেবল একজন নারীর তো অবশ্যই নয়। সুতরাং নারী কেনো তার গর্ভাবস্থাকে কয়েদীদের মতন রেখেঢেকে চলবে? এই বার্তাটি পরী মনির এই ছবিতে সুস্পষ্ট।
সবশেষে পরীমণি ও শরীফুল রাজের সন্তান জন্ম দেওয়ার এই যাত্রার প্রতি রইলো অনেক অনেক অভিনন্দন, আশীর্বাদ ও শুভকামনা। সমাজের প্রচলিত বাতিলযোগ্য নিয়মগুলোকে এভাবে পায়ে দলে এগিয়ে যেতে হবে। এই চলার পথে আমাদের সমর্থন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা রইলো।