সানজিদা সুলতানা

হিউম্যানিস্ট এক্টিভিস্ট

পরীমনি এবং আপনাদের অবদমন

বাংলাদেশে কোনো একটা ঘটনা ঘটলে বেশিরভাগ সময়ে মানুষ দু‘টি ভাগ হয়ে যায়, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে। এর মাঝে যেন কেউ নেই, কিছু নেই। বর্তমানে চলমান পরীমনি আটক ঘটনায় দুই পক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণঃ

এক,

বাংলাদেশে কারো ঘরে মদ রাখা কি আইনতঃ অবৈধ?

২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদন বা পারমিট থাকলে কোনো ব্যক্তির মাদ্যপান করা আইনতঃ বৈধ। অনুমোদন থাকলে কোনো দেশী কিংবা বিদেশী নাগরিক একবারে সাথে করে এক লিটার পরিমান মদ নিতে পারবেন এবং মাসে সাত লিটারের মধ্যে মদ পান করতে পারবেন।

এখন একজন লাইসেন্সধারী মদ্যপানকারীর বাসায় যদি আপনি ১৯ লিটার মদ খুঁজে পান, আর সেটা তিনি যদি কোভিডের কারণে তিন মাস খাওয়ার জন্য জমা করেন বা অন্য লাইসেন্সধারীদের সাথে নিয়ে খাওয়ার জন্য কেনেন, সেক্ষেত্রে আপনি কীভাবে একজন মদ্যপানকারী নাগরিকের ওপর সেটার খবরদারী করবেন? তার ঘরে ঘরে সিসি টিভি ক্যামেরা লাগাবেন? মানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথা বললাম। বিষয়টি পরিষ্কার না, এখানে আইনের অপব্যবহারের সুযোগ আছে।

এই মদ রাখার কারণে লাইসেন্সধারী কাউকে আটক করা বা তার বাসার সব মদ জব্দ করা কেনো বেআইনী হবে না, সেটাও একটা প্রশ্ন।

আইনসিদ্ধ হলেই যে কোনো বিষয় নৈতিক হবে এমন কোনো কথা নেই। অবশ্য রাস্ট্র আর সমাজভেদে নৈতিকতা ভিন্ন হতে পারে, সেটা অনেক সময় আইন প্রনয়নে প্রভাবক হিসেবেও কাজ করে। তদুপরিও আইন এবং নৈতিকতা সমান নয়।

তাও আমরা অতীতে দেখতে পাই, মদখোর প্রেসিডেন্টদের কেউ কেউ কখনো কখনো ধর্মীয় সামাজিক নৈতিকতাবোধের প্রভাব খাটিয়ে সাধারন মানুষের উপর বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছেন। যেমন বাংলাদেশের এই হাস্যকর মদ খাওয়া আইন। মদ খাওয়াকে সামাজিক নৈতিকতার পাল্লায় মাপা প্রশাসন আবার ১৯৩৮ সাল থেকে কেরু এন্ড কোং নামের একটি সরকারী মদপ্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান থাকার পরেও ২০০৩ সালে বেসরকারী মদ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যমুনাকে অনুমতিও দেন। সে ভিন্ন আলাপ।

দুই,

বাইরের দেশে সুগার বেবি বলে নাগরিক, আয়কর, এবং রাস্ট্রীয় জবাবদিহিতার বাইরে একটি হাওয়াই পেশা প্রচলিত আছে। যেটা বাংলাদেশেও অপ্রচলিত নয়। বিশেষ করে মিডিয়া জগতে দারুণ জনপ্রিয়। এই পেশা কি আইনতঃ দন্ডনীয় অপরাধ?

বাংলাদেশে সুগার বেবি বিষয়টি আইনগত অভিধানেই নেই। সুতরাং সুগার বেবি হিসেবে প্রাপ্ত উপহার, সেটা যত দামীই হোক, সেটার যাবতীয় আইনগত বাধ্যবাধকতা পরিশোধ করার দায়িত্ব সাধারনত উপহারদাতারই হবার কথা। উপহার গ্রহীতার নয়। সুগার বেবি কিন্তু প্রচলিত অর্থে বেশ্যাবৃত্তি নয়। সুতরাং এই পেশার জন্য কেউ অনুমতি পত্র নিলো, এই ক্লায়েন্ট থেকে এত টাকা পেলো, আর এত টাকা পেয়ে তার এত শতাংশ আয়কর দিলো, সেটা সম্ভব না। আর সুগার বেবিদের উপহারের উপর আয়কর ধরা হলে বাংলাদেশে সকল প্রেমিক প্রেমিকার, বন্ধু বান্ধবের, শ্বশুরবাড়ির, নেতাকর্মীদের, মন্ত্রী কর্মকর্তা, আমলাদেরকে দেয়া উপহারের উপরও আয়কর ধরা উচিত। চিনিকন্যাদের ক্ষেত্রে এক আইন, বাকিদের ক্ষেত্রে ভিন্ন আইন, এটা তো হতে পারে না।

তিন,

সুগার বেবি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বেশ্যাবৃত্তি প্রসঙ্গটি চলে এলো? বাংলাদেশে কি বেশ্যাবৃত্তি বেআইনী? না। তবে এই নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে এবং আইনে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আছে। ২০০০ সালের পিটিশনে হাইকোর্ট পতিতাবৃত্তিকে বৈধ বলে রায় দিয়েছে। যে কারণেই সরকার কর্তৃক পতিতাপল্লী উচ্ছেদকে বেআইনী বলা হয়েছে। আবার সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র জুয়া এবং যৌন ব্যবসার বিরুদ্ধে কার্যকরী সুরক্ষা প্রদান করিবে।'

এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের সুবিধা যদি আইন রক্ষাকারী সংস্থা নেয়, সেটা কেনো অন্যায় হবে না, এটাও একটা প্রশ্ন।

চার,

কোনো উপযুক্ত সাবালক নারী পুরুষ পরস্পর সম্পর্ক করলে সেটা কি বেআইনী?

না। বেআইনী নয়। তবে পৃথিবীর কোনো সভ্য সমাজেই এটিকে গ্রহণযোগ্যতা দেয় না। অর্থাৎ ব্যাপারটি আনএথিক্যাল বা অনৈতিক। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ে অনৈতিকতার স্বীকার সঙ্গীটি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসে, আবার হিলারী ক্লিন্টনের মতো করে নানাবিধ কারণে থেকেও যায় অনেকেই, বিশেষ করে বাঙালি নারীরা। কিন্তু তবুও সেটিকে আইনগতভাবে অপরাধ বলেও গণ্য করা হয় না। এখানেও যেটা বোঝা যায়, আইন আর এথিকস কে গুলিয়ে ফেললে সেটা একটা বড় সমস্যা।

পাঁচ,

কে তার বাসায় কি কাপড় পরলো, কী করলো, কোথায় বেড়ালো, অন্যের ক্ষতি না করে, সেটা রঙ চড়িয়ে প্রকাশ করে কাউকে প্রতিনিয়ত হেনস্তা করা কি সাংবাদিকতার সাধারন শিক্ষার সাথে যায়? না, যায় না। এটাকে বলে হলুদ সাংবাদিকতা।

ছয়,

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কোনো তদন্ত বা বিচার প্রভাবিত করার জন্য কারো সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক করা কি অপরাধ? হ্যা, প্রমানিত হলে এটি অবশ্যই অপরাধ।

সাত,

কারো বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে তার সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে জড়ালে সেটা তদন্ত সুষ্ঠ হবার পেছনে অন্তরায়? হ্যা। এতে তদন্ত গ্রহণযোগ্য এবং নিরপেক্ষ হবার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। এবং এটি পেশাগত শর্তকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। প্রমানিত হলে এটিও বড় ধরনের অপরাধ।

আট,

ইচ্ছাকৃত ভাবে কারো নামে মিথ্যা ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ আনা কি অপরাধ? হ্যা, প্রমাণিত হলে আইনের দৃষ্টিতে অবশ্যই অপরাধ। সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া ভিডিওগুলো দেখে ইতোমধ্যেই ব্যাপারটি অনেকটাই প্রমাণিত যে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগটি মিথ্যা। তারপরেও এটি এখনও তদন্তাধীন, তাই সোশ্যাল জাজমেন্ট দিলাম না।

নয়,

অনুমতি ছাড়া কারো ব্যক্তিগত ছবি ভিডিও অনলাইনে ছড়ানো কি অপরাধ? হ্যা, আইনের দৃষ্টিতে এটি সাইবার ক্রাইম হিসেবে বিবেচিত এবং এটিও অপরাধ।

শেষ চারটি কারণ নিয়ে আলোচনা হতো, জিজ্ঞাসাবাদ হতো, খারাপ হতো না। কিন্তু বাকি হাবিজাবি যেইসব কারণে আজ পরীমনি হেনস্তা হচ্ছে সেটা দুঃখজনক। পরীমনির মিডিয়ার সামনে গঙ্গাযমুনা কান্নাকাটির কারনণে কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই জনৈক ব্যাবসায়ীকে যেভাবে হেনস্তা করে তার মানহানী করা হয়েছে, এটিও দুঃখজনক এবং অন্যায় হয়েছে।

একটি অন্যায় দিয়ে আরেকটি অন্যায়কে জাস্টিফাই করা যায় না। এর আগে পরীমনির করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলেছি। আজকে পরীমনির সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে বললাম।

শতভাগ এথিকস এর স্বর্গীয় দেশে, শতভাগ এথিক্যাল মানুষেরা আজকে পরীমনিকে নিয়ে তাদের অবদমিত খিস্তি দিচ্ছে তো, কালকে তারাও এই অন্যায়ের স্বীকার হতে পারে। আফসোস, হয়তো ক্যামেরা থাকবে না সামনে।

1511 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।