ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

প্রীতিলতা: আঁধার পথে পাড়ি দেওয়া এক দুঃসাহসী নারী

২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সাল। পাহাড়তলি, চট্টগ্রাম।

পাহাড়তলি রেলস্টেশনের পাশেই রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাব। কিছুদিন ধরে এই ক্লাবটিই ব্যবহৃত হচ্ছে ইউরোপিয়ান ক্লাব হিসাবে। নিরাপত্তার খাতিরে চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়া থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে এখানে। প্রতি শনিবার রাতে ব্রিটিশ অফিসার এবং তাঁদের স্ত্রীরা আসেন। চলে অপরিমিত পানাহার এবং বল ড্যান্স। আজকেও তেমনি এক শনিবারের রাত। সন্ধ্যার পর থেকেই সমবেত হয়েছেন সকলেই। আনন্দপিয়াসী, উৎফুল্ল মেজাজ সবার। কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে সামান্য চিন্তার কারণে সতর্কও সকলেই। প্রায় সবার কাছেই আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। বাইরেই সশস্ত্র পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। চট্টগ্রাম ইউরোপিয়ান ক্লাবের বাইরে যে সাইনবোর্ড লাগানো থাকতো, এখানেও সেই একই সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে, ভারতীয় এবং কুকুরদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

রাত প্রায় নটা। পানীয়ের প্রভাবে তরল হয়ে এসেছে প্রায় সবাই। সতর্কতায় ঢিল পড়েছে। লঘু হাস্য এবং কৌতুক শোনা যাচ্ছে নাচের ফাঁকে ফাঁকে। ঠিক এসময়ই ক্লাবের পিছনের রান্নাঘরের ছোট্ট জানালার পাশে এসে দাঁড়ায় এক গ্রাম্য যুবক। হাতে একটা টর্চলাইট। ক্লাবেরই বাবুর্চি সে। সতর্কভাবে আশেপাশে তাকায়। তারপর হাতের টর্চটাকে বাইরের দিকে নিশানা করে। যুবকের হাতে জ্বলে উঠেই নিভে যায় টর্চলাইটটা। এরকম করে ঠিক তিনবার করে সে অতি দ্রুত।

অন্ধকার আকাশ থেকে নরক ভেঙে পড়ে যেন ক্লাবের উপর। খাকি সামরিক পোশাক পরা আটজন সশস্ত্র তরুণ হামলে পড়ে বঙ্গোপসাগরের প্রবল ঝড়ের মতো। মুহূর্তের মধ্যে গান, নাচ এবং হাসি বন্ধ হয়ে যায় ইউরোপিয়ান ক্লাবের। এর পরিবর্তে শোনা যেতে থাকে বোমার ভয়ংকর আওয়াজ, মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। চারিদিকে শুধু নরনারীদের গগনবিদারী আর্তনাদ, ভয়ার্ত চিৎকার। প্রাণভয়ে জানালা ভেঙে অনেকেই পালিয়ে যেতে থাকে অন্ধকারে। মাত্র পনের মিনিটের মধ্যে থেমে যায় গুলি এবং বোমার শব্দ। মৃত্যুর হাহাকার এবং ধ্বংসলীলার মধ্যে শুধু শোনা যেতে থাকে আহতদের যন্ত্রণাকাতর ভয়ার্ত গোঙানি।

কোথাও বেজে উঠে একটা হুইসেলের শব্দ। সেই শব্দে আক্রমণকারী যুবকেরা সারি বেঁধে ফিরে যেতে থাকে। সামরিক প্রথামতে তাঁদের নেতা সবার পিছনে। জানালা ভেঙে পালানো একজন ইংরেজ যুবক লুকিয়ে ছিলো নালার ভিতরে। পাগড়ি মাথার নেতাকে চোখে পড়ে তাঁর। খুব সন্তর্পণে নিজের কাছে রাখা অস্ত্র দিয়ে গুলি করে সে। বুকে গুলি লাগে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অধিনায়ক।

ঘন্টাখানেক পরে পুলিশ, মিলিটারি ও গোয়েন্দাদের দিয়ে ভরে যায় আশপাশ। রাস্তার উপরে পড়ে থাকা অধিনায়কের মৃতদেহ তুলে নিয়ে পোস্ট মর্টেমের জন্য পাঠানো হয়। পোস্ট মর্টেম করতে গিয়ে খোলা হয় মাথার পাগড়ি। সাথে সাথেই একরাশ দীর্ঘ কালো চুল বের হয়ে আসে পাগড়ির ভিতর থেকে। হতভম্ব সবাই আবিষ্কার করে কোনো পুরুষ নয়, শ্যামল বরণ একজন তরুণীর মৃতদেহ এটি।

বিহ্বল এবং বিমূঢ় সকলের সামনে পোস্ট মর্টেম টেবিলে নিথর শুয়ে থাকেন মাতৃভমির জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে জীবন আত্মোৎসর্গকারী, বাংলার প্রথম নারী শহীদ, বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

২.
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত, দুজনেই চট্টগ্রামের খাস্তগীর গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। প্রীতিলতা, কল্পনা দত্তের এক ক্লাস উপরে পড়তেন। কিন্তু, তা সত্ত্বেও দুজনের সম্পর্ক ছিলো বন্ধুর মতো।

মেধাবী ছাত্রী তিনি। ম্যাট্রিকে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। অত্যন্ত ভালো রেজাল্ট এটা, তবে স্কলারশিপের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রীতিলতার প্রবল ইচ্ছা ছিলো কোলকাতায় পড়ার। কিন্তু, তার দরিদ্র পিতামাতার পক্ষে কোলকাতায় তাকে রেখে পড়ানোর সঙ্গতি তাঁদের ছিলো না। কল্পনা দত্ত উল্লেখ করেছেন যে, এ কারণে তার এবং রানী (প্রীতিলতার ডাকনাম) দু’জনেরই মন খুব খারাপ ছিলো। রানী ছাত্রী হিসাবে খারাপ ছিলো না, তবে অংকে কাঁচা ছিলো। অংকের কারণেই স্কলারশিপ পাওয়া হয় না তার। ঢাকার ইডেন কলেজে আই এ তে ভর্তি হয় সে। কল্পনা দত্ত তখনও স্কুলে পড়ে। প্রীতিলতার চেয়ে বছর দু’য়েকের ছোট ছিলো কল্পনা। পরের বছর ম্যাট্রিক পাশ করে কল্পনা চলে যায় কোলকাতায় পড়তে। দুই বান্ধবীর সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটে। ছুটি ছাটাতে বাড়িতে এলে অবশ্য দেখা হতো পরস্পরের সাথে।

১৯৩০ সালের পূজোতে দু’জনেই বাড়িতে রয়েছেন। প্রীতিলতা নিমন্ত্রণ করেছেন কল্পনাকে। খাওয়ার সময় পাঁঠার মাংস খেতে গিয়েই প্রসঙ্গটা উঠে আসে। ‘পাঁঠা জবাই দিতে কে পারবে? কার এই সাহস আছে? হইহই করে কল্পনা বলে উঠলেন, “অবশ্যই আমি পারবো। সোজা কাজ এটা।” “পাঁঠা জবাইতে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু, তারপরেও আমার পক্ষে ঠাণ্ডা মাথায় একটা অবলা জীবকে হত্যা করা সম্ভব হবে না।” ম্রিয়মান কণ্ঠে প্রীতি বলেন। প্রীতির এই কথা শুনে কেউ একজন মশকরা করে উঠলো।“কী? দেশের মুক্তির সংগ্রাম কি অহিংস উপায়ে করতে চাও নাকি তুমি?” প্রীতির উত্তরটা এলো কঠোর গলায়। “দেশের জন্য যেখানে নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত আমি, সেখানে প্রয়োজন হলে কারো জীবন নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবো না আমি। কিন্তু, তারপরেও এই অবলা প্রাণীকে হত্যা করতে পারবো না আমি।”

দেশের জন্য অন্যের প্রাণ নেওয়া এবং নিজের জীবন বিসর্জন করার এই দুঃসাহসী কথা যে কথার কথা ছিলো না, তা মাত্র দুই বছরের মাথায় প্রমাণ করে দেন তিনি।

প্রীতিলতা একবার নিজে ডায়েরিতে লিখেছিলেন:

“কোনপথে আমি জীবনকে ভাসিয়ে দিলাম? এই তো আমার টেবিলের সামনে রাধাকৃষ্ণের ছবি। এই প্রেম স্বর্গীয়। এমনভাবেই মাতৃভূমিকে আমাকে ভালোবাসতে হবে। অন্য কোনো প্রেম ভালোবাসা আমার হৃদয়ে স্থান পাবে না। রাধার মতোই আমার দেশপ্রেম আমি উজাড় করে দেবো, নিজেকে নিঃশেষে আমি দান করে যাবো।”

কথা রেখেছিলেন তিনি। নিজেকে সত্যি সত্যিই নিঃশেষে দান করে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি জন্মভূমির জন্য। একুশ বছর বয়সের একটা তরুণীর যখন কোনো তরুণের সাথে গভীর ভাব-ভালোবাসা করার কথা, তখন তিনি সযত্নে সেই প্রলোভনকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। নিজের প্রতিটা মুহূর্ত তিনি ব্যয় করেছেন মাতৃভুমির কলঙ্ক মোচনের উদ্দেশ্যে। তিল তিল করে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন উৎসর্গ করার উদ্দেশ্যে। তাঁর আত্মাহুতি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, নয় কোনো দুর্ঘটনা। দেশের প্রয়োজনে আত্মাহুতির জন্য নিজেকে ঘষে মেজে অনেক যত্নে তৈরি করেছিলেন তিনি।

৩.
বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী এই নারীটির আজ আত্মাহুতি দিবস। এখন থেকে চুরাশি বছর আগে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে গিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তিনি। প্রীতিলতা নামের এক অসম সাহসী, অসীম দেশপ্রেমী তরুণীটির এই অসামান্য আত্মত্যাগ এবং অকাতর আত্মোৎসর্গকে বোঝার মতো উপলব্ধি আমাদের আছে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে আমার। পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের কিছুদিন আগে প্রীতিলতা পূর্নেন্দু দস্তিদারকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। পূর্নেন্দু দস্তিদার তখন জেলে। সেই চিঠিতে প্রীতিলতার নিজের লেখা একটা কবিতা ছিলো। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষের সেন্সরের কাঁচি তার পুরোটাকেই খেয়ে ফেলেছিলো। শুধু শেষ দু’টো লাইন পৌঁছেছিলো পূর্নেন্দু দস্তিদারের কাছে। সেই দুই লাইন এরকম:

আঁধার পথে দিলাম পাড়ি/মরণ-স্বপন দেখে।

প্রীতিলতার পোস্ট মর্টেম করার সময়ে তাঁর সামরিক পোশাকের মধ্যে নিজ হাতে লেখা একটি বিবৃতি বের হয়ে আসে। অত্যন্ত যত্নে তিনি এটিকে অন্য একটি কাগজে মুড়ে পোশাকের ভিতরে রেখে দিয়েছিলেন। বেশ বড়সড় একটি বিবৃতি এটি। বেশ ভেবেচিন্তেই তিনি বিবৃতিটি লিখেছিলেন। দেখিয়েছিলেন তিনি এটি সূর্য সেনকে। সূর্য সেন পড়ে অনুমোদনও দিয়েছিলেন। এই বিবৃতিটি পড়লেই বোঝা যায় যে, প্রীতিলতা জানতেন, এই আক্রমণের পরে তাঁর জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। সে কারণেই শেষ লাইনে তিনি লিখেছিলেন, এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।

বিবৃতিটি সরকারী পক্ষ আদালতে হাজির করেছিলো। বিবৃতিটির অংশ বিশেষ এরকম:

“দেশের মুক্তি-সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিলো। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেনো উহা পারিবো না? ইতিহাসে অনেক উদাহরণ আছে, রাজপুত রমণীরা অসীম সাহসের সহিত রণাঙ্গনে যুদ্ধ করিতেন এবং স্বদেশের স্বাধীনতা ও নারীত্বের মর্যাদা রক্ষার জন্য তাহারা শত্রুর প্রাণ-সংহার করিতে কিছুমাত্র দ্বিধা করিতেন না। ইতিহাসের পৃষ্ঠা এইরূপ কত নারীর বীরত্বগাথায় পূর্ণ। তবে কেনো আমরা, আজিকার ভারতীয় নারীরা বিদেশীর দাসত্বশৃংখল হইতে নিজের দেশকে পুনরুদ্ধার করিবার জন্য এই মহান যুদ্ধে যোগদান করিব না? যদি বোনেরা ভাইদের সঙ্গে কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিতে পারে, তবে সশস্ত্র বিদ্রোহে যোগদানে তাহাদের বাধা কি? সশস্ত্র বিদ্রোহে অন্য দেশের বহু নারী যোগদান করিয়াছে, তবে কেনো ভারতীয় নারীরা বিপ্লবের এই পন্থাকে অন্যায় বলিয়া মনে করিবে?

নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়াছে যে, আমার দেশের ভগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন –এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।”

2322 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।