সানজিদা সুলতানা

হিউম্যানিস্ট এক্টিভিস্ট

একটি পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগ এবং তার সাতকাহন

আজকে অনলাইনে এবং অফলাইনে একজন অতিশয় সরব নারী অধিকার কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, লেখক, এবং নিজেকে নারীবাদী পরিচয় দেয়া মানুষের লেখা পড়ার দুর্ভাগ্য হলো। লেখা না বলে আসলে দীর্ঘদিন যাবৎ হয়ে আসা পারিবারিক নির্যাতনের উপাখ্যান বলাই ভালো। দুই বছর কারো জন্য খুব কম মনে হলেও নির্যাতনের হিসেবে দীর্ঘ সময়ই বলা চলে। ৭৩০ দিন অনেক বড় একটা সময় নিয়মিত শারিরীক, মানসিক নির্যাতন হজম করার জন্য। সেটিও একজন অতিশয় পরিচিত, সচেতন, নারীবাদী, রাজনৈতিকভাবে সরব এবং আপাদমস্তক সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে পরিচিত একজনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ গুরুতর।

এক, সম্পর্কে বিশ্বস্ত থাকবার শর্ত ভঙ্গ করে বিভিন্ন নারীর সাথে ভার্চুয়ালি এবং সরাসরি জড়িয়ে পড়া।

দুই, প্রতিনিয়ত সঙ্গীকে শারিরীক এবং মানসিক নির্যাতন করা।

তিন, নানাজনের সাথে নিজেদের ন্যুড চালাচালি করে, আবার সঙ্গিনীর বিভিন্ন ছবিও তার অগোচরে বিভিন্নজনের সাথে শেয়ার করা।

এই তিনটিই সাধারন দৃষ্টিতে এবং আইনতঃ দন্ডনীয় অপরাধ। প্রথমটি হয়তো বাংলাদেশের আইনের বয়ানে পরিষ্কার নয়। কারণ, সম্পর্কটি যেহেতু আইনতঃ লিপিবদ্ধ বা রেজিস্টার্ড বলে পরিষ্কার হয়নি অভিযোগে। এইজন্য সাধারন দৃষ্টিতে কথাটি উল্লেখ করলাম।

চার নাম্বার অভিযোগটি অত গুরুতর আমার মনে হয়নি, কিন্তু বিরক্তকর। সেটি হলো, নির্যাতক এবং শর্তভঙ্গকারী ব্যক্তিটির সঙ্গিনীর উপর প্রায় শতভাগ অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা। নারী সঙ্গীর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা পুরুষ মেনে নিলে পুরুষ সঙ্গীর নির্ভরশীলতাও মেনে নিতে পারেন কেউ কেউ। সেটিকে দোষের ধরছি না। কিন্তু কেউ যদি এটি মানসিকভাবে মেনে না নেয়ার পরেও আবেগী কারণে মেনে নিতে বাধ্য হন, সেক্ষেত্রে সেটি অন্যায়। এবং তার দায় দুইজনের ওপরই বর্তায়। কেনো আপনি মেনে নিয়েছেন, আর কেনো অন্যজন এভাবে সঙ্গীর অসন্তোষ সত্ত্বেও তার ঘাড়ের ওপর ভুতের মত চেপে বসে খেয়েছেন?

এই গেলো সাধারন আলাপ। ভুক্তভোগী চাইলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। যদি নিতে চান আর কি। নইলে হয়তো সোশ্যাল মিডিয়ার আদালতে তুলে দুটো তিরষ্কার খাইয়ে চুপও মেরে যেতে পারেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে চাইবো তিনি আইনের আশ্রয় নিন। নইলে এভাবে কাউকে শুধু ভার্চুয়ালি মব জাস্টিসের হাতে তুলে দেয়াটা সুস্থ চর্চা না। যদি আইনের আশ্রয় নিয়ে এটি ফেসবুকে তুলতেন, সেক্ষেত্রেও কথা ছিলো।

আমরা একজনের কথা শুনেছি। অপরজনের বক্তব্য আমরা জানি না। তো, সেই একজনের বক্তব্য সত্য ধরে নিয়েই আমার কাছে কয়েকটি গুরুতর বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে।

এক, বাংলাদেশে নারীবাদ চর্চা যারা করেন, তাদের আসলে এই বিষয়টি পরিষ্কার কিনা। ধরে নিচ্ছি নারীবাদের একাডেমিক আলোচনা তারা খুব ভাল বোঝেন। যদি বুঝে থাকেন, তাহলে ব্যক্তিগত জীবনে তারা তার চর্চা করতে পারছেন না কেনো? যেই বক্তব্য আমার সারাজীবনের কন্ঠস্বর, অর্জন, সেই বক্তব্যকে যদি আমার জীবনে ধারণই করতে না পারি, তাহলে সেই বক্তব্যকে অন্য কারো জন্য তুলে ধরবার অধিকার আমি রাখি কিনা?

এ তো দেখি ধর্মান্ধদের মতো অবস্থা হয়ে গেলো। "আমি ভালো কথা নিজের জীবনে ধারণ করতে পারিনি বলে আরেকজনকে বলতে পারবো না, তা তো নয়।"

না আপনি পারেন না। যেই মতবাদের চর্চা আপনি নিজের জীবনে করতে পারছেন না, সেই মতবাদের চর্চা আপনি আরেকজনকে করতে বলারও নৈতিক অধিকার রাখেন না।

কাউকে দেখি মদ খাইয়ে আরেকজন নারীকে ধর্ষণ করার সব জাল বিছিয়ে রাখছেন, তো কাউকে দেখি মাত্র তিনমাসের মাথাতেই অসততা ধরা পড়ার পরেও দুই বছর ধরে পড়ে পড়ে সঙ্গীর কিল খেয়ে বালিশ ভেজাচ্ছেন। আপনারা দয়া করে নিজেদের জীবনে নারীবাদকে ধারণ না করতে পারলে নারীবাদের গুষ্ঠি উদ্ধার করে এটিকে আর গালিতে রূপান্তরিত করবেন না। এমনিতেও উপমহাদেশের নারীর পায়ে পায়ে সাপ। তাদের অনেকের অবস্থা আপনাদের এই ঐচ্ছিক অত্যাচারিত হবার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি গুরুতর। তার উপর আপনাদের এই দ্বিমুখী জীবন, আমাদের মেয়েদের উপকার না করে আরো ক্ষতি করছে। আপনাদের অনেক সরব নারীবাদীদের জীবনের ছোট ছোট প্রকাশিত উপাখ্যান, এক একটি শেকল হিসেবে কাজ করছে আরো শতাধিক নারীর জন্য।

এবার আসছি নারীবাদী পুরুষদের কথায়। বাংলাদেশের নারীবাদী পুরুষ যেই কয়জনের চেহারা প্রকাশিত হয়েছে, তারা মোটামুটি পুরুষবাদী পুরুষের মতই, সাথে খোলস একটা বেশি, ওটাকে খাঁটি বাংলায় 'টোপ' বলে। ধারণা করি, সকাল বিকাল তিনবেলা বাংলাদেশের আইনের শাসনের গুষ্ঠী উদ্ধার করে সেই জিনিসের অন্যায় সুবিধা নেয়ার জন্যই আপনাদের জীবনের যতো আয়োজন।

আপনাদের নিয়ে আসলে আমার বলার কিছুই নাই। যারা আপনাদের কেঁচোর টোপকে বিরিয়ানী মনে করে গেলে, আমার সকল সতর্কবার্তা কেবল তাদের জন্য।

তো আপুরা এবং ভাইয়ারা, আমরা উক্ত ঘটনাটি থেকে কী শিখলাম? আমরা শিখলাম, ভার্চুয়াল চকচকে, ঝকঝকে বাঁধানো ছবি দেখলেই নিজের জীবনের অপূর্ণতা নিয়ে হাপিত্যেস করতে নেই। সে আলোর নিচে অন্ধকার আছে কিনা তা আমরা জানি না।

আমরা আরো শিখলাম, কেউ নীতি, আদর্শ, ন্যায়, নিষ্ঠা ইত্যাদি সকল মহান পর্বতসম বিশেষণের ফেনিল সমুদ্দুর ঢেউ উঠিয়ে ফেললেই সেখানে ডাইভিং করার জন্য ঝাপিয়ে পড়তে নেই। এক কোটি মিটারেরও নীচের অতল গহবরে মিলিয়ে যেতে পারেন। বাকি 'বামা নামা' আর নাইবা বয়ান করলাম।

সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা।

2212 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।