এ বছর ২৬শে সেপ্টেম্বর দিনটি দুটো কারণে গুরুত্বপূর্ণ, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী এবং মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয় দ্বারা ভারতীয় দণ্ডবিধির চরম নারী বিদ্বেষী ধারা ৪৯৭ এর বিলোপ সাধনের প্রথম বর্ষপূর্তি। এই ধারাটি বিলোপ হবার সাথে সাথে দেশের বিভিন্ন মহলে প্রচণ্ডভাবে গেলো গেলো রব ওঠে, যেনো পরিবারকাঠামো এই আইন রদ হবার সাথে সাথেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে, যেনো এই আইনের ওপরেই পরিবারকাঠামো এতো শতাব্দী ধরে টিকে রয়েছে! যারা চিৎকার করেছেন, তারা অধিকাংশ জানেনই না পরিষ্কারভাবে যে কী আদৌ ছিলো এই ধারাটিতে, পড়েও দেখেননি অথবা পড়লেও তলিয়ে দেখেননি। আসুন আরও একবার দেখে নেয়া যাক, কী ছিলো এই আইনে ...
"কোনো পুরুষ যদি জানেন যে একজন নারী অপর একজন পুরুষের স্ত্রী , এটা জেনেও নারীটির স্বামীর অজ্ঞাতে বা অসম্মতিতে ওই নারীর সাথে যৌনসংসর্গে লিপ্ত হন, তাহলে সেই যৌনসংসর্গ ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না, ব্যভিচার (Adultery) বলে গণ্য হবে যার শাস্তি হবে পুরুষটির সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড, অথবা অর্থদণ্ড , অথবা উভয়ই একত্রে। নারীটি এই কাজের মদতদাতা বা অ্যাবেটর হিসেবে কোনো শাস্তি পাবেন না।"
স্বঘোষিত পণ্ডিতকুল এই আইনটি বিলোপের সাথে সাথেই চিৎকার করতে লাগলেন, মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয় "পরকিয়ার" বৈধতা দিয়ে দিয়েছেন, অথবা যেনো বাধ্যতামূলকই ঘোষণা করে দিয়েছেন! অর্থাৎ এই আইনটির বলে বিবাহ বহির্ভূত শরীরী সংসর্গে আইনি বাধা বজায় ছিলো, পরবর্তীতে আর রইলো না! আসলেই কি তাই? চলুন একটু দেখে নেয়া যাক ।
প্রথমত, এই ধারাটির বলে, "শুধুই অপর পুরুষের স্ত্রীর সাথে একজন পুরুষ যৌন সংসর্গ করলে আইনি বাধার বা শাস্তির সম্মুখীন হবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। ঢালাওভাবে বিবাহ বহির্ভূত শরীরী সম্পর্ক করতে কোনো আইনি বাধার কথা উল্লেখ করা নেই। অর্থাৎ, একজন পুরুষ যদি ইচ্ছে করেন, কোনো অবিবাহিতা, বিবাহ বিচ্ছিন্না অথবা বিধবা নারীর সাথে শরিরী সংসর্গ করতে পারেন, কোথাও কোনো আইনি বাধা অথবা শাস্তি হবে না!
দ্বিতীয়ত, আইনের এই ধারাটি নারীর রক্ষাকবচের কাজ কোনোভাবেই করেনি। অর্থাৎ, যদি কোনো নারীর স্বামী স্ত্রী ব্যতীত অপর নারীর সাথে শরীরী সংসর্গে লিপ্ত হন, এই ধারার বলে ওই সংসর্গকারী পুরুষটির স্ত্রী কোনোভাবেই স্বামীর বিরুদ্ধে ফৌজদারী অভিযোগ আনতে পারবেন না , এই আইনটিতে নারীর সে অধিকারের কথা কোথাও উল্লেখ নেই। মামলা করতে পারবেন শুধুই সংসর্গকারী নারীর স্বামী, অর্থাৎ একজন পুরুষ! পক্ষান্তরে সংসর্গকারী পুরুষটির স্ত্রীর কাছে আইনের আশ্রয় নেবার কোনো পথ খোলা ছিলো না। অর্থাৎ আইনটি নারীবান্ধব ছিলো না, নারীর জন্য কোনো প্রটেকশান এই আইন দেয়নি।
তৃতীয়ত, যদি নারীটির স্বামী জ্ঞাত বা সম্মত থাকেন তবে ওই নারীর সাথে যে কোনো পুরুষের যৌনসংসর্গ চলতে পারে, সম্পূর্ণভাবে আইনের প্রশ্রয়ে, এই ধারাটি অনুযায়ী... সেখানে অপর কেউ যেহেতু এ নিয়ে অভিযোগ জানাবার অধিকারী নন, স্বামী ব্যতীত। এখানে নারীটির সম্মতি অসম্মতির বিষয়টি গৌণ, স্বামীর সম্মতির বিষয়টিই মুখ্য। অর্থাৎ এই ধারাটির অপব্যবহার করে যে কোনো সময়ে যে কোনো পুরুষ তাঁর স্ত্রীকে এমনকী দেহব্যবসায় অথবা অপর অভীষ্ট সিদ্ধিতে স্ত্রীকে তাঁর অসম্মতিক্রমেও শারীরিকভাবে ব্যবহার করতে পারতেন! সমস্যায় পড়লে বিষয়টিকে ব্যভিচারের নাম দিয়ে ধামাচাপা দেবার রাস্তাও স্বামীটির পক্ষেই খোলা ছিলো।
চতুর্থত, আইনের এই ধারাটি এই বিষয়টিকেই প্রতিষ্ঠা দেয়, বিবাহিত নারীর শরীরের মালিক বা অধিকারী তার স্বামী। স্বামী যদি সম্মতি বা অনুমতি দেন অপর পুরুষকে, তার স্ত্রীর সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হতে, তাহলে সেটা আইনের চোখে রীতিমতো বৈধ! কোনো অন্যায় নেই, দোষঘাট নেই, শাস্তি নেই! একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে স্বামীটি যদি বিবাহিতা নারী ব্যতীত অপর নারীর সাথে যৌনসংসর্গে লিপ্ত হন, আইনে তাকে কোনো বাধা দেয়া হবে না কিন্তু স্ত্রীর সেই অধিকার কোনোভাবেই নেই।
সেই মহাকাব্যের কাল থেকেই নারীর শরীরের মালিকানা তার পরিবার বা স্বামীর , অথবা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের, তার নিজের কোনোভাবেই নয়। দ্রৌপদীর শরীরকে শাশুড়ির মুহূর্তের সিদ্ধান্তে বহুভোগ্যা করে দেয়া হলো, তার নিজের সম্মতি অসম্মতির কেউ তোয়াক্কা করেনি। ভোজরাজকন্যা পৃথা কুন্তী তাঁর কানীনপুত্র কর্ণকে জলে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হন, অপর পুরুষের সন্তান ছিলো বলে। লক্ষ্যণীয়, বিবাহের পর সেই অপর পুরুষ দ্বারা উৎপন্ন সন্তানই কিন্তু রাজার আদরে লালিত হলো বংশজ সন্তানরূপেই, কেননা সেই একাধিক অপর পুরুষের সাথে শরীরী মিলনে ছিলো কুন্তীর শরীরের প্রভু পাণ্ডুর সম্মতি। স্বামী বিচিত্রবীর্যের অকালমৃত্যুর পর কাশীরাজকন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকাকে বংশরক্ষার তাগিদে চরম অনিচ্ছায় হতে হয়েছিলো ভাসুর বেদব্যাসের অঙ্কশায়িনী, শাশুড়ি সত্যবতীর আদেশে। পৃথিবী জানবে , সন্তান স্বামীর নয়, স্বামী তো মৃত! তবু তা সমাজস্বীকৃত ছিলো ।
এইখানেই মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয় সভ্যতার পথে আরও একটি ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন ভারতীয় আইন ব্যবস্থাকে, মেকলেসাহেবের পশ্চাদমুখী বিধি থেকে, বিবাহিত নারীকে তার শরীরের অধিকার বা মালিকানা ফিরিয়ে দিয়েছেন। এখানেই এই যুগান্তকারী রায়টির ইউএসপি। "পরকীয়ার" বৈধতা নয়, বিবাহিত নারীর শরীরের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া। সেই মহাকাব্যের কাল থেকে আজ অবধি এই তথাকথিত আধুনিক যুগেও বিবাহ মানেই শারীরিক দাসত্ব, একতরফা নারীর দিক থেকে, এই মনুবাদী এবং কদর্য রিগ্রেসিভ "ঐতিহ্যকে" রীতিমতো আইনি বৈধতা দেয়া ছিলো যে ধারাটির মাধ্যমে, সে ধারাটি রদ করে মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয় নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত সদর্থক পদক্ষেপ নিয়েছেন ।
পঞ্চমত, এই ধারাটির বলে নারীর কোনো শাস্তির বিধান ছিলো না , কেননা নারীকে এখানে মানুষ হিসেবে দেখাই হয়নি, দেখা হয়েছে বস্তু হিসেবে, তার স্বামীর সম্পত্তি হিসেবে ।
লক্ষ্যণীয় এখানে লড়াই হচ্ছে দুজন পুরুষের, স্বামী এবং প্রেমিকের, নারী এখানে অবজেক্ট মাত্র, ঠিক সেই গোষ্ঠীযুগের মতো! অর্থাৎ একজন পুরুষের সম্পত্তিতে অপর একজন পুরুষ থাবা বসিয়েছে, অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত হবে তারা দু'জন । নারী যেহেতু এখানে সম্পত্তিমাত্র, তার অবস্থানটাই এখানে গৌণ। সম্পত্তির কখনো শাস্তি হয় না, সে জড়বস্তু মাত্র, তাকে কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি ।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে এই ধারাটির বলে কোনোভাবেই পুরুষের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে বিশেষ লাগাম পরানোর ব্যবস্থা ছিলো না, আইনের ফাঁকটা যথেষ্ট বড় ছিলো। যেটা ছিলো সেটা হলো বিবাহিত নারীরা স্বামীর অসম্মতিতে বা অজ্ঞাতে অপর পুরুষের অঙ্কশায়িনী হতে পারবেন না। স্বামীদেবতা বা শরীরের মালিক অনুমতি দিলে অবশ্য ঢালাওভাবে তাঁরাও পারবেন। অথচ এই নারীবিদ্বেষী রিগ্রেসিভ ধারার বিলোপে নারীকুলও সমানভাবে চেঁচিয়েছেন গেলো গেলো করে। এবার নাকি পরিবারকাঠামোই ভেঙে পড়বে! সে পড়ার হলে এমনিই পড়বে, কান্নাকাটি করে কিন্তু ঠেকানো যাবে না। এই ধারা বলবৎ থাকাকালীনও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক কিছু থেমে থাকেনি!
কালের নিয়মে বর্তমান পরিবারপ্রথা একদিন এমনিতেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে সম্ভবত, ইতিহাস তো পরিবর্তনেরই সাক্ষী দেয়। অরণ্য থেকে গুহা, গোষ্ঠী, মাতৃতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র এর সবটাই পরিবর্তনের ফল। মাত্র দুই প্রজন্ম আগের যৌথ পরিবারপ্রথা এখন অণু পরিবারপ্রথায় পর্যবসিত। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, বিবাহ প্রথার যে গুরুত্ব ছিলো, গত দেড় দশকে ভারতীয় আইনব্যবস্থা যেভাবে এগিয়েছে, তাতে সেই গুরুত্ব আর নেই। বিবাহ এবং পিতৃতান্ত্রিক পরিবারপ্রথার যে মূল উদ্দশ্য, তা হলো ব্যক্তিগত সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিরঙ্কুশ করা। বর্তমান ভারতীয় আইনব্যবস্থায় নারীপুরুষের বিবাহ না হলেও, তাদের সন্তান পিতামাতা উভয়ের সম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে পাবে, যেটা কিছুকাল আগেও ছিলো না। অর্থাৎ, সন্তানের সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেতে হলে বাবা মায়ের বিবাহ হওয়াটা জরুরী নয় ।
এই সঙ্গেই "অবৈধ সন্তান" বলে কদর্য শব্দবন্ধটিও ভারতীয় আইনব্যবস্থায় অফিশিয়ালি অবান্তর হয়ে গেছে। এই শব্দটি বা "স্টেটাস"টি, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও তজ্জনিত খেয়োখেয়ির আবহেই মানুষের ঘাড়ে চাপানো হয়েছিলো।
ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা বিলোপ করে মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয় বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের ঢালাও স্বীকৃতি দিয়েছেন, এই ভাবনা অবান্তর এবং অমূলক। কে কার সাথে সংসর্গে লিপ্ত হবেন কি হবেন না, নারীপুরুষ নির্বিশেষে, এটি মহামান্য ন্যায়ালয় ব্যক্তিমানুষের বিবেচনার ওপর সোপর্দ করাই যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন, অত্যন্ত যথাযথভাবে। খোলাই রয়েছে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা করবার পথ, নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই। স্বামী বা স্ত্রীর অন্যতর শরীরী সংসর্গ বা সম্পর্কের কারণে কেউ যদি তার সাথে থাকতে না চান , বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করতে পারেন। আদালতের বা পরিস্থিতির বিবেচনা অনুযায়ী পেতে পারেন ভরণপোষণের আর্থিক খরচ, দীর্ঘমেয়াদী বা আজীবনও।
বিদ্যাসাগর আজ বেঁচে থাকলে তিনি দুহাত তুলে আশীর্বাদ করতেন নিশ্চিত, ওপরাপর পণ্ডিত ছিলেন না যে! সারাজীবন তিনি নারীর অধিকারের জন্য লড়েছেন। তাঁর কালেও তাঁকে শুনতে হয়েছে দেশে অস্পৃশ্যতা, অনাহার এতো সমস্যা, তবুও বেটা মেতে আছে বিধবাগুলোর "বে" নিয়ে! আজ থাকলেও শুনতে হতো! সব যে বদলায়নি তা তো বেশ টের পাওয়া যায়! যেখানে, যতোবার , যেভাবেই নারী তার কোনো না কোনো অধিকার ফিরে পাবে, অর্জন করবে, ততোবার তাঁর নবজন্ম হবে, তাঁরই জয় হবে! তাঁর জন্মদিনটিকে এই সন্ধিলগ্ন হিসেবে বেছে নিয়ে আরো একবার মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয় তাঁর জয় ঘোষণা করেছেন। বেঁচে থাকো বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়।