বাংলাদেশ অনেক বড় প্রাপ্তি হারালো। সেইসঙ্গে আমরাও হারালাম এক কিংবদন্তী ভাস্করের ভাস্কর্য, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগী বীরাঙ্গনার স্মৃতি রক্ষার মাইলফলক হয়ে থাকতো। It was great lost for the nation and for us. আনা ইসলামের 'নভেরা বিভুঁইয়ে স্বভূমে' বইয়ের বিশেষ একটা অংশে বীরাঙ্গনাদের স্মরণে ভাস্কর্য নির্মাণে ভাস্কর নভেরা আহমেদের ইচ্ছা প্রকাশের কথা পড়ার পর দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে উপলব্ধি করি, what a great lost!
আমি এখানে আনা ইসলামের "নভেরা বিভুঁইয়ে স্বভূমে" বইয়ের পৃষ্ঠা ১৯ থেকে লেখকের ভাষায় উদ্ধৃত ভাস্কর নভেরা আহমেদের ইচ্ছা প্রকাশের অংশটুকু হুবুহ তুলে ধরছি।
"মুক্তিযুদ্ধে নিহত ও নির্যাতিত নারীদের স্মরণে বৃহৎ ভাস্কর্য করার আকাঙ্ক্ষা ছিল নভেরার। এই পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ১৯৯৯ সালে ইউনেসকোর আমন্ত্রণে ইউনেসকো শান্তি পুরুস্কার নিতে প্যারিসে এসেছিলেন। শেখ হাসিনা ঢাকায় চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিনকে বলেছিলেন, এ যাত্রায় ভাস্বর নভেরার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি নভেরাকে প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহের কথা জানাই। গ্রেগোয়ার (নভেরার স্বামী) আশ্বস্ত করেন, নভেরা দেখা করবেন। আর নির্দিষ্ট দিনের আগে টেলিফোনে জানান, প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে নভেরা নিজেই যাবেন দেখা করতে, প্রধানমন্ত্রীকে আসতে হবে না। ২২ সেপ্টেম্বর সোমবার নির্ধারিত সরকারি কর্মসূচির বাইরে এই সাক্ষাতের সময় উপস্থিত ছিলাম আমি ও শিল্পী শাহাবুদ্দিন। প্যারিসে হোটেল হিলটনের কক্ষে সোয়া একঘন্টা আলাপকালে নভেরা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন তার ইচ্ছার কথা। স্বাধীনতাযুদ্ধের নয়মাসে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা নির্যাতিত মৃত মা-বোনদের স্মরণে ও সম্মানে সরকারি অনুদানে একটি বিশাল ভাস্কর্য করতে চান। প্রধানমন্ত্রী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছিলেন নভেরাকে। নানা সামাজিক সংস্কার, প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যেভাবে নভেরা ভাস্কর্যের মতো শ্রমসাধ্য মাধ্যমে এলেন, তা নিয়েও প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা জানিয়ে নভেরাকে বলেছিলেন, ঢাকাতে নভেরার করা প্রথম উদ্যানভাস্কর্য জাতীয় জাদুঘরের সামনের উন্মুক্ত সবুজ প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হবে। ব্যবসায়ী এ আর খানের ফার্মগেটে বাড়ির সামনে এটি ছিল। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহের কথা জেনে সেই ব্যবসায়ী পরিবার জাদুঘরকে সেটি দান করেন। ১৯৯৭ সালে নভেরাকে একুশে পদক দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি এই পদক গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলেছিলেন, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে তিনি পদক নিতে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নভেরাকে বলেছিলেন, তাঁকে একুশে পদক প্রদানের জন্য দেশে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
সাক্ষাৎ শেষে শেখ হাসিনা নভেরাকে এক প্যাকেট রসগোল্লা দিয়েছিলেন। ভাস্কর নভেরা বিদায়ের আগে কক্ষে আসেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা। শেষ বিকেলে নরম আলোয় কালো শাড়ি পরা নভেরা যখন বেরিয়ে আসছিলেন, তখন অনেক জোড়া বাঙালি আর ইউরোপীয় চোখ নিবদ্ধ ছিল তাঁর দিকে।
সরকারিভাবে অনুষ্ঠান করে ভাস্কর নভেরাকে পদক তুলে দেওয়া হয় নি। কথা হয়েছিলো বাংলাদেশে গিয়ে ভাস্কর্য নির্মাণ করবেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে নভেরার সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ নিতে পারে নি। "
ভাস্কর নভেরা আহমেদের আর দেশে ফেরা হয় নি। ২০১৪ থেকে তিনি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে তার অবস্থার অবনতি ঘটে। মৃত্যুর দুই দিন আগে তিনি কোমায় চলে যান। কয়েকদিন পর ৬ই মে, মঙ্গলবার প্যারিসের স্থানীয় সময় ভোর তিনটা থেকে চারটার মধ্যে ৭৬ বছর বয়সে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান।
ভাস্কর নভেরা আহমেদ একটি রহস্য এবং বিস্ময়ের নাম। আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের কিংবদন্তী, বিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের প্রথম নারী ভাস্কর নভেরা আহমেদ। বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যের ইতিহাসে যার অবদান অতুলনীয় এবং অন্যতম অগ্রদূত তিনি গত কয়েক দশক ধরে তিনি বাংলাদেশের বাইরে থাকেন। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে, জীদে, অপমানে, অসম্মানে ভাস্কর নভেরা আহমেদ দেশ ছাড়া থাকেন। পঞ্চাশের দশকে পুরুষের আধিপত্যের কারণে তাঁর মতো কঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী, সৃষ্টিশীল, স্বাধীনচেতা নারীর দেশে স্থান হয়নি। তবে তাঁর ভেতর ছিল প্রবল দেশপ্রেম। আজন্ম বাংলাদেশের পাসপোর্ট বহন করে গেছেন।
ভাস্কর নভেরা আহমেদ দেশজ উপলব্ধিতে তাঁর শিল্পচর্চা চালিয়ে যান। তাঁর বেশকিছু ভাস্কর্যে আবহমান বাংলার লোকজ আঙ্গিকের আভাস পাওয়া যায়। তবে লোকজ ফর্মের সাথে সেখানে পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়ও বর্তমান। লোকজ টেপা পুতুলের ফর্মকে সরলীকৃত করে তাকে দক্ষতার সঙ্গে বিশেষায়িত করেছেন তিনি। এভাবে ঐতিহ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষার স্বার্থক ভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা তাঁর আধুনিক চিন্তার লক্ষণ। বাংলাদেশের ষাটের দশকে রাজনৈতিক অস্থিরতা নভেরার শিল্পকর্মকে প্রভাবিত করে। সেই সময় বাঙালি সত্তার পরিচয় অর্জনের সংগ্রাম চলছিলো। দেশের রাজনীতি এবং আর্থসামাজিক পটভূমিকায় নির্মিত ভাস্কর্য নভেরার বাঙালি সত্তা উপলব্ধির স্মারক হয়ে আছে।
ভাস্কর নভেরা আহমেদের হাতে গড়া বীরাঙ্গনাদের ভাস্কর্য অবশ্যই কালোত্তীর্ণ ভাস্কর্য হতো এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের দূর্ভাগ্য সেই বিশাল প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তবে নভেরা আহমেদ অনন্তকালের যাত্রার মধ্য দিয়ে অনেক প্রশ্ন রেখে গেছেন। সেই সঙ্গে প্রকাশ করে গেছেন বীরাঙ্গনাদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা। এই মহীয়সী নারীর সৃষ্টির মাঝে তাঁর শিল্পসত্তা কথা বলবে যুগ যুগ ধরে, থেকে যাবেন মহাকালের সোপানে। তাঁর প্রয়াণ দিবসে জানাই তাকে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা।
